সাংবাদিকতার চার যুগ-১

এবাদত আলী
১৯৬৮ সালের কথা। তখন আমি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে কলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আমার গ্রামের বাড়ি ছিলো পাবনা সদর থানার মালিগাছা ইউনিয়নের বাদলপাড়া গ্রামে। আমাদের গ্রাম থেকে কলেজের দুরত্ব অধিক হওয়ার কারণে আমি পাবনা সদরের গোপালপুরে জায়গির থাকতাম আমার এক নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে। এই বাড়ির উত্তর পাশে গোপালপুরের জোলার পাড়ে একটি প্রকান্ড তেঁতুল গাছ থাকায় ঐ বাড়ির নাম ছিলো তেঁতুলগাছওয়ালা বাড়ি। তেঁতুল গাছের জন্য ঐ বাড়ির মালিকের নাম কেউ যেমন সহসা বলতোনা ঠিক তেমনি এলাকায় আমার নামও হয়েছিলো তেঁতুল গাছওয়ালা বাড়ির মাস্টার। কোন স্কুলে শিক্ষকতা না করেও আমরা খেতাব পেয়েছিলাম মাস্টার। অর্থাৎ যারা জায়গির থাকতো তাদেরকে বলা হতো অমুক ছাত্র অমুকের বাড়ির মাস্টার। গোপালপুর গ্রামের লাগোয়া গ্রাম ছিলো বাহাদুরপুর, আফোরি, বৈকুন্ঠপুর ও চকচিরোট। আমার জায়গির বাড়িটি ছিলো ঠিক মাঝামাঝি স্থানে। তাই ঐসকল গ্রামে আমার মত যারা জায়গির থাকতেন তারা প্রায়ই আমার এখানে আসতেন। আমিও তাদের জায়গির বাড়িতে যেতাম। ফলে আমাদের সকলের মাঝে সখ্যতা গড়ে ওঠে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে যেসকল ছেলেরা লেখাপড়া করতো তাদের সাথেও মাস্টারদের ছিলো নিবিড় বন্ধুত্ব। এক কথায় আমরা লেখাপড়ার অবসরে সকলে মিলে চুটিয়ে আড্ডা দিতাম।
এরই মাঝে আমরা ‘বাহাদুরপুর আলোক সমিতি’ নামে একটি সমিতিও গঠন করি। যার কার্যালয় ছিলো বাহাদুরপুর তেমাথায়। সমিতির সভাপতি ছিলেন চকচিরোটের হারেজ আলী ( টেবুনিয়া ওয়াছিম পাঠশালার অবসর প্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক(বর্তমানে মৃত), আর আমি ছিলাম সাধারণ সম্পাদক। এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখের সাথে তাই আমরা ছিলাম অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। এক সময় হঠাৎ করে বাহাদুরপুর, আফোরি ও বৈকুন্ঠপুরে মহামারি আকারে কলেরা দেখা দেয়। আমরা কতিপয় ছাত্র তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। কিন্তু আমাদের কাছে তো আর ওষুধ-পথ্য নেই। তাই আমরা ছুটে যাই সদর থানা হেলথ অফিসে। কিন্তু থানা হেলথ অফিসারের কাছ থেকে তেমন আশানুরূপ সহযোগিতা পওয়া যায়না। আমরা তাই পাবনা সদর মহকুমা হাকিম (এসডিও) এর অফিসে গিয়ে জানতে পারি তিনি মফস্বলে আছেন। অগত্যা সিভিল সার্জনের নিকট গিয়ে সব কথা খুলে বলি। তিনি আমাদেরকে বলেন শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু কলেরা আক্রান্ত রোগীদের জন্য তেমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়না। এদিকে কলেরা আরো দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এমন সময় এলাকার একজন মুরুব্বি বলেন, বাবা, এম্ব^া করে কোন কাজ হবিনানে। তোমরা যদি পারো তো কোন সুম্বাদিকের কাছে যাও। আর সুম্বাদিকরা যদি পিপারে এই খবর ছাপায়ে দেয় তাহলি দেখপের পারবেনে সব অফিসাররা ক্যাম্বা করে বাপ বাপ করে ছুটে আসপিনে। সেই মুরুব্বির কথায় আমরা খুবই গুরত্ব দেই। আমরা কজন মিলে একটি অভিযোগ নামা লিখি। কাঠ পেন্সিল দিয়ে সাদা কাগজের নিচে কার্বন ধরে কয়েকটি কপি করি। কিন্তু সাংবাদিকের দেখা পাবো কোথায়?
চাইলেই তো আর সাংবাদিকের দেখা পাওয়া যায়না। তবে এডওয়ার্ড কলেজের একজন ছাত্র রবিউল ইসলাম রবি দৈনিক সংবাদের সাংবাদিক বলে আমি জানতাম। কিন্তু এদিন ৯ জুলাই ১৯৬৮ কলেজে গিয়ে বহু খুজাখুজি করেও তার দেখা পেলামনা। তার বাড়ির ঠিকানা না জানায় গেলাম ‘চিত্রাকাশ’র সাংবাদিক টিআইএম রিয়াজুল করিম হিরোকের খোঁজে। তাকেও পাওয়া গেলনা। অগত্যা আমরা পাবনা প্রেসক্লাবের উদ্দেশ্যে শহরের নতুন গলিতে গেলাম। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম সাংবাদিকরা সন্ধ্যার পরে আসবেন। হঠাৎ মনে হলো একজন সাংবাদিকের কথা। তিনি হলেন মির্জা শামসুল ইসলাম। বেশ কিছু দিন আগে পাবনা মডার্ণ আর্ট প্রেসে (আবুল হোসেন ওরফে আবু মিয়ার প্রেস) তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিলো। তিনি তখন দৈনিক পাকিস্তানের ষ্টাফ রিপের্টার। (ক্রমশ:)। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব
তারিখ: ১১/০৩/২০২৫

preload imagepreload image