বিচার বিভাগের জন্য সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে ঐকমত্যে পৌঁছেছে সুপ্রিম কোর্ট এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। একাধিক বৈঠকের পরই বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এদিকে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্ট থেকে পাঠানো এ সংক্রান্ত খসড়া ও প্রস্তাবিত সচিবালয়ের অর্গানোগ্রাম যাচাই-বাছাই করছে আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে রুলস অব বিজনেস ও অ্যালোকেশন অব বিজনেসের কোন কোন ক্ষেত্রে সংস্কার দরকার কি না, সেটাও বিবেচনায় আছে মন্ত্রণালয়ের। খসড়া চূড়ান্ত হলেই পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার আইন অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হবে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। এদিকে সচিবালয়ের নাম কি হবে সেটাও পরীক্ষানিরীক্ষা করা হচ্ছে। বিচার বিভাগীয় না সুপ্রিম কোর্ট নামে সচিবালয় করা হবে সেটা নিয়েও চলছে যুক্তিসংগত আলোচনা।
আইনজ্ঞরা বলছেন, বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা হলে অধস্তন আদালতের বিচারকগণের পদায়ন, বদলি, পদোন্নতি, শৃঙ্খলা, ছুটি ইত্যাদি বিষয়ে প্রচলিত দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটবে। নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা। অধস্তন আদালতের ওপর সকল ধরনের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপও বন্ধ হবে।
নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথককরণসংক্রান্ত মাসদার হোসেন মামলার রায়ের দুই যুগ পর পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নের্তৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করা হয় বিচার বিভাগ। এরপর ১৭ বছর কেটে গেলেও আওয়ামী লীগ সরকার পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
গত ৫ আগস্ট দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নেওয়ার আড়াই মাসের মধ্যে বিচার বিভাগের জন্য সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠায় আইন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা প্রেরণের নির্দেশ দেন বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। ঐ নির্দেশনার পর সুপ্রিম কোর্ট থেকে গত ২৭ অক্টোবর পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার খসড়াসহ সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা প্রেরণ করা হয়। এই প্রস্তাবনা নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। এরপরই গত ১০ ডিসেম্বর হাইকোর্টের স্পেশাল অফিসার মো. মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির তিন সদস্যের একটি টিম আইন ও বিচার বিভাগের সচিবের কক্ষে আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাগণের উপস্থিতিতে বিচার বিভাগীয় সচিবালয়ের বিভিন্ন কৌশলগত বিষয়গুলো উপস্থাপন করেন। এরপরই বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠনের বিষয়টি পুনরায় বেগবান হয়।
সুপ্রিম কোর্ট বলছে, বর্তমানে বিচার বিভাগীয় সচিবালয় তৈরির বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়ে সক্রিয়ভাবে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আশা করা যায় অচিরেই বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় স্থাপনের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট ও মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপসমূহ দৃশ্যমান হবে।
গত ২১ সেপ্টেম্বর নিম্ন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশ্যে দেওয়া অভিভাষণে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় স্থাপনের জন্য শিগগিরই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে জানান। এরই ধারাবাহিকতায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের সকল বিচারপতিদের মতামত গ্রহণ করে পৃথক সচিবালয় গঠনসংক্রান্ত প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রস্তাবনায় বলা হয়, বিচার বিভাগ পৃথককরণসংক্রান্ত মাসদার হোসেন মামলার রায়ে ক্ষমতার পৃথকীকরণের যে রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে তার অন্যতম মৌলিক ভিত্তি হলো দেশের বিচার বিভাগের জন্য একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা। এ কথা সত্য বিগত বছরগুলোতে রাজনৈতিক সরকারের অনীহার কারণে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ সম্ভবপর হয়নি। জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ঐ রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের এখনই শ্রেষ্ঠ সময়।
প্রসঙ্গত, সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট বিভাগের অধস্তন সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হাইকোর্ট বিভাগের ওপর অর্পণ করা হয়েছে। কিন্তু হাইকোর্ট বিভাগের এই তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ নয়। কেননা বিদ্যমান কাঠামোতে আইন মন্ত্রণালয় হতে অধস্তন আদালতসংক্রান্ত বিভিন্ন প্রস্তাব আসার পর হাইকোর্ট বিভাগ তার তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে। তাই সাংবিধানিক এই বাধ্যবাধকতা সুচারুরূপে সম্পন্ন করার জন্য পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা অত্যাবশ্যক বলে মনে করে সুপ্রিম কোর্ট।