তুলসীর বক্তব্যে : ভারতীয় সাংবাদিকদের প্রশ্নের শুধুই জবাব নাকি যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক (ডিএনআই) তুলসী গ্যাবার্ড গত ১৬ মার্চ ভারত সফরে আসেন। দিল্লিতে দেশটির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। এরপর ভারতীয় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ নিয়ে বিতর্কিত জবাব দেন। তার এই মন্তব্যকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে আলোচনা-সমালোচনার। কোনো নির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই এই ধরনের বিভ্রান্তিকর মন্তব্যের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া।

এছাড়া তুলসীর এই মন্তব্য ভারতীয় প্রোপাগান্ডানির্ভর এবং সত্যের অপলাপ বলে মনে করছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল এবং কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারাও তুলসী গ্যাবার্ডের দেওয়া এই ধরনের অভিযোগকে সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

তারা বলছেন, তুলসী গ্যাবার্ড ভারতীয় প্রোপ্রাগান্ডার সুরে তাল মিলিয়েছেন। অন্যদিকে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলেও তুলসী গ্যাবার্ডের মন্তব্যে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় সম্পর্কে প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল এনডিটিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তুলসী বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি ও বিশেষ করে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন ‘গভীর উদ্বিগ্ন’ বলে মন্তব্য করেন। বাংলাদেশ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ইসলামি সন্ত্রাসবাদীরা নানা দেশে ‘ইসলামি খেলাফতে’র আদর্শে শাসনক্ষমতা হাতে নিতে চায়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার প্রশাসন এই আদর্শকে পরাস্ত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। ‘ইসলামি সন্ত্রাসবাদে’র বিপদ বাংলাদেশকেও প্রভাবিত করছে। পাশাপাশি বার্তা সংস্থা এএনআই’কে দেওয়া দ্বিতীয় আর একটি সাক্ষাৎকারেও এমন মন্তব্য করেন তুলসী গ্যাবার্ড।

এই মন্তব্যের জেরে বাংলাদেশ সরকার এক বিবৃতিতে নিজেদের অবস্থান জানায়। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ইসলাম চর্চার জন্য সুপরিচিত এবং চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। গ্যাবার্ডের মন্তব্য কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ বা অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে করা হয়নি বলে বাংলাদেশ সরকার ওই বিবৃতিতে দাবি করেছে। সরকার বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে, তুলসী গ্যাবার্ডের বক্তব্যে পুরো বাংলাদেশকে অন্যায় ও অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

সরকারের সঙ্গে একমত হয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোও প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এটা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে একটা বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। তার সঙ্গে সারা দেশবাসী একমত। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যেসব মিস ইনফরমেশন, তার ভিত্তিতে (তুলসী গ্যাবার্ড) বক্তব্য দিয়েছে। সরকার এটা কনডেম করেছে। আমরাও কনডেম করি।’

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আমরা এর (তুলসী গ্যাবার্ডের বক্তব্যের) তীব্র নিন্দা জানাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাপ্রধান হিসাবে তিনি বাংলাদেশ নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তাদের ভাষায় সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার, তাদের অধিকার খর্ব করা হচ্ছে, কিন্তু এই কথাগুলো একেবারেই অসত্য। এগুলো আবার ভারতীয় গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের স্থিতিশীল পরিবেশকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য এটি আন্তর্জাতিক চক্রান্ত বলেই আমরা মনে করি।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম-আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, তুলসী গ্যাবার্ড ভারতে এসে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে উদ্বেগ দেখিয়েছেন। আমরা মনে করি, তার এমন মন্তব্যের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার বা রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়নি। এটা সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত মন্তব্য। ভারতে বাংলাদেশবিরোধী যেসব প্রোপাগান্ডা হয় তিনি সেটা দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে এই মন্তব্য করছেন।

এইদিকে কূটনীতিক বিশ্লেষকরা অনেকে মনে করেন, তুলসি গ্যাবার্ডের বক্তব্যে এসেছে এক ধরনের সতর্কবার্তা, যা বাংলাদেশের জন্য নতুন করে শঙ্কা তৈরি করতে পারে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষিক সম্পর্কের কোনো পরিবর্তন দৃশ্যমান নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের নীতি এখনও স্পষ্ট না হওয়ায় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা আছে বলে বলছেন বিশ্লেষকেরা।

তাদের মতে, এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে প্রমাণ করতে হবে তারা গণতন্ত্রের পথে হাঁটছে। দীর্ঘ সময় নির্বাচন না হলে বাংলাদেশকে অনির্বাচিত সরকারের দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার ঝুঁকি থাকছে।

কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলেন, বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে- এমন একটা ধারণা নতুন করে সামনে এসেছে। এর সঙ্গে এখন প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশকে আড়চোখে দেখার সুযোগ দিতে পারে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যালেন্স রক্ষা করে এই সফরকে কীভাবে ব্যবহার করে, তার ওপরও বিষয়টা নির্ভর করে।

সাবেক এই কূটনীতিক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রধানের বক্তব্যকে অন্য কোনোভাবে ব্যাখ্যা না করে বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রমাণ করতে হবে। সেই সাবধানবার্তা এসেছে বলেই তার ধারণা।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সাঈদ ইফতেখার আহমেদ মনে করেন, চীনকে ঠেকিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থের জন্য যা করার প্রয়োজন হবে, সেটাই করবে। আর এর অংশ হিসেবে ভারতকে পাশে রেখে ওই ধরনের বক্তব্য এসেছে, যা বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর হচ্ছে। সেটা বিবেচনায় নেওয়ার অবস্থানে নেই যুক্তরাষ্ট্র।

preload imagepreload image