এবাদত আলী
আরেকজন সাংবাদিকের কথা জানতাম। তিনি হলেন সাংবাদিক আনোয়ারুল হক। তিনি তখন ইউনাইটেড ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার পাবনা শাখায় কর্মরত। সেই সঙ্গে সাংবাদিকতার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৭ সালের মার্চ মাসে পাবনায় ভুট্টা আন্দোলনের ঘটনা ঘটে। সেই আন্দোলনের খবর পত্রিকায় প্রকাশ করার কারণে তিনি তখন জেল খানায়। পাবনা প্রেসক্লাবে গেলে সাংবাদিকের দেখা পাওয়া যাবে। বিশেষ করে আমার অতি পরিচিত সাংবাদিক রবিউল ইসলাম রবি ভায়ের সাক্ষাৎ পাবো এই ভরসায় সন্ধ্যা বেলায় সেখানে গিয়ে হাজির হলাম। আমরা জনা কয়েক কলেজ ছাত্র পাবনা শহরের নতুন গলিতে গিয়ে সরু একটি সিঁড়ি দিয়ে দোতালায় উঠলাম। একটি কক্ষে বসে কয়েকজন সাংবাদিক আলাপ আলোচনায় ব্যস্ত। প্রথমেই যাঁর সঙ্গে পরিচয় হলো তিনি হলেন সাংবাদিক এডভোকেট রনেশ মৈত্র। আরো সাক্ষাৎ পাই সাংবাদিক মির্জা সামছুল ইসলামের। আমরা সেই কলেরা আক্রান্ত এলাকার একটি বর্ণনা তুলে ধরি এবং হাতে লেখা সেই দরখাস্তের কার্বন কপি তাঁদের হাতে দেই। তাঁরা আমাদের হাতের কাগজ খানা নিয়ে অতি উৎসাহ ভরে বল্লেন, আমরা এবিষয়ে চুড়ান্ত ব্যবস্থা নিচ্ছি।
পাবনা প্রেসক্লাবের সাংবাদিকগণ সেদিন কেমনভাবে কি ব্যবস্থা নিয়েছিলেন তা জানিনা তবে দুদিন পর সকাল বেলা কলেরা আক্রান্ত এলাকায় এসে হাজির হলেন থানা হেলথ অফিসার। সঙ্গে তার দলবল। এর কিছুক্ষণ পর এলেন পাবনার সিভিল সার্জন। কলেরা আক্রান্ত রোগিদের সেবায় তার লোকজন ওষুধ-পথ্য নিয়ে কাজে নেমে পড়লো। এলাকার সকল মানুষকে কলেরা ভ্যাকসিন দেওয়ার পাশাপাশি বাসি-পচা খাদ্য না খাওয়ার পরামর্শ দিলেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এলেন পাবনার ডিসি মঃি একে এম হেদায়েতুল হক । রাধানগর মক্তব থেকে কাঁচা রাস্তা ধরে ময়দানপাড়া এসে তাঁর জিপ গাড়ি রেখে ময়দানপাড়ার জোলা নৌকাতে পার হয়ে কমলা বিলের কাদামাটি মাড়িয়ে জমির আইল বেয়ে পায়ে হেঁটে তিনি বাহাদুরপুর গ্রামে পৌছলেন। তাঁর সাথে ছিলেন সদর মহকুমা এসডিও। তারা এলাকার লোকজনকে আশ্বস্ত করলেন এই বলে যে, আপনাদের কোন ভয় নেই। যতদিন পর্যন্ত এই এলাকা থেকে কলেরা একবারে নির্মুল না হবে ততদিন পর্যন্ত আমাদের মেডিকেল টিম এখানে থাকবে। এহেন ঘটনার অবতারনায় এলাকায় ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়।
পরে অবশ্য জেনেছিলাম পাবনার সাংবাদিকগণ পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশ করার ফলে ঢাকার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় থেকে ডিসি ও সিভিল সার্জনের উপর দারুন চাপ আসতে থাকে। তাই তারা ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে। যেকাজ আমরা ক’দিন ধরে ঘোরাঘুরি করে সমাধা করতে ব্যর্থ হয়েছিলাম সেকাজ অতি সহজেই সাংবাদিকদের দ্বারা সম্পন্ন হওয়ায় এলাকার মানুষজন যেমন খুশি হলেন তেমনি সাংবাদিকতা করার প্রতি আমি দারুনভাবে অনুপ্রাণিত হলাম। এর আগেও অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম ১৯৬৬ সালে। তখন সবেমাত্র রাধানগর মজুমদার একাডেমী (আরএম একাডেমী) হতে এসএসসি পাশ করে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছি। আমার সহপাঠি বন্ধু আটঘরিয়ার নজরুল ইসলাম রবি, (বর্তমানে অবসর প্রাপ্ত মেজর জেনারেল), নাটোরের কেএম মোনায়েম (স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ), শরিফ উদ্দিন শরিফ (ঈশ্বরদীর চরকামালপুর হাই স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক, মৃত), নূরুল ইসলাম নুরু (বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ পাবনা সদর থানার সাবেক কমান্ডার, (মৃত), আব্দুর রশিদ বিশ্বাস (সাবেক প্রধান শিক্ষক দেবোত্তর কবি বন্দে আলী মিয়া উচ্চ বিদ্যালয়),সহ অন্যান্যরা মিলে ‘রাধানগর ধ্রুবতারা সংঘ’ নামে একটি সংঘ গঠন করি। আমাকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। রাধানগর ধ্রুবতারা সংঘের পক্ষ থেকে পাবনা বনমালী ইনস্টিটিউটে প্রসাদ বিশ্বাসের ‘জবাবদিহি’ নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। ১৯৬৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর তারিখে মঞ্চস্থ হওয়া উক্ত নাটকে আমি হাস্যরস চরিত্র পিতাম্বরের ভূমিকায় অভিনয় করি। এই নাটক মঞ্চায়নের খবর চিত্রাকাশ পত্রিকার পাবনাস্থ প্রতিনিধি টিআইএম রিয়াজুল করিম হিরোক তা উক্ত নাটকের খবর পত্রিকায় প্রকাশ করেন। প্রকাশিত খবরটি ছিলো নিম্নরুপ:- গত ২৯ সেপ্টেম্বর স্থানীয় বনমালী রঙ্গমঞ্চে রাধানগর ধ্রুবতারা সংঘের প্রযোজনায় তাদের প্রথম নাট্য অবদান প্রসাদ বিশ্বাস রচিত সামাজিক নাটক জবাবদিহি মঞ্চস্থ হয় রাত্রী ৮.৩০ মিনিটে। নাটকটি পরিচালনা করেন শরীফ আহমদ। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের অধ্যক্ষ আমিনুল হক।
জবাব দিহি ধ্রুবতারা সংঘের প্রথম অবদান, তাছাড়া প্রায় সমস্ত শিল্পীরই প্রথম মঞ্চবতারণ তাই এ নাটকের ভুলত্রুটির সমালোচনা করতে চাইনা অতি দুরের দৃষ্টিকোণ থেকে। তাই নিঃসন্দেহে তাদের এ প্রচেষ্টাকে সার্থক বলা যেতে পারে। তবে এই নাটকের অভিনয় ছাড়া অন্য যে সমস্ত ত্রুটি অভিজ্ঞ লোকদের হাত দিয়ে ঘটেছে ক্ষমাহীন ভাবেই তা তুলে ধরছি। পাবনার সবে ধন নীলমণি রূপসজ্জাকর জনাব আয়েন উদ্দিন রূপসজ্জায় আগাগোড়াই ব্যর্থতার পরিচয় বহন করে আসছেন। শিল্প নির্দেশনা ও মঞ্চসজ্জায় যে লোকগুলো ছিলো তাদের ভুমিকা ঠিক বুঝতে পারলামনা। তারা কেবল নাম প্রচারের ইচ্ছা ত্যাগ করে যথাযথ দায়িত্ব পালন করলে নাটকটি যে আরো প্রাণবন্ত হতে পারতো তা নিঃসন্দেহে বলা চলে। আলোক সজ্জাতে তপন কুমার কোন নতুনত্ব দেখাতে পারেননি। সঙ্গীত পরিচালক বেতার শিল্পী হাসানুজ্জামান তালুকদার অনুষ্ঠানে সারাক্ষণ অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও তাঁর নাম বিভিন্ন ভাবে ঘোষণা করার কোন অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারলামনা। কণ্ঠ সঙ্গীতে গোলাম সরওয়ার খান সাধন অপূর্ব কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। নাটকটির বিভিন্ন চরিত্রে অংশ নেন অমলেন্দু কুমার, নুরুল ইসলাম নুরু, নজরুল ইসলাম রবি, এবাদত আলী, আব্দুস সাত্তার, ইকরামূল হক, মোনায়েম, শওকত হোসেন স্বপন, মঙ্গল কুমার, শরীফ উদ্দিন, আবুল কাসেম প্রমুখ শিল্পীগণ। পরিচালনা সার্থকতার দাবিদার। আগামীতে ধ্রুবতারা সংঘের কাছ থেকে আরো সার্থক নাটক আশা করি। চিত্রাকাশে প্রকাশিত সেই নাট্য সমালোচনাও ছিলো আমার জন্য প্রেরণার উৎস। এছাড়া পাবনা এডয়ার্ড কলেজে অধ্যয়ন কালে আমি বার্ষিক সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রতিযোগীতা ও হাস্য-কৌতুকে অংশ নিয়ে প্রায়ই প্রথম কিংবা দ্বিতীয় হতাম। একবার এই খবর সাংবাদিক রবিউল ইসলাম রবি দৈনিক সংবাদে প্রকাশ করলে অর্থাৎ উক্ত খবরে আমার নাম ছাপা হওয়ায় আমি ঐ পত্রিকাটি উপযাচক হয়ে অনেককেই দেখিয়েছিলাম এবং সযতনে টিনের স্যুটকেচে রেখে দিয়েছিলাম। (ক্রমশ:)।
(লেখক সাংবাদিক ও কলামিস্ট)
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।
তারিখ: ২৪/০৩/২০২৫.