ছোট আমলে বড় সওয়াব

দুনিয়া আমল করার জায়গা। মৃত্যুর পর আমলের সুযোগ নেই। দুনিয়ার আমল অনুযায়ী চিরস্থায়ী পরকাল কারো সুখের হবে, কারো হবে দুঃখের। তাই বেঁচে থাকতে মুমিনকে বেশি বেশি আমল করতে হবে। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, দান-সদকা এবং কোরআন হাদিসে বর্ণিত দোয়া-তাসবিহ সম্পর্কে আমরা অনেকে জানি। কিন্তু এর বাইরেও সহজে আমল করার মতো অনেক আমল রয়েছে। কিছু আমল খুবই সহজ, কিন্তু প্রতিদান অনেক বড়। এখানে হাদিসের আলোকে সেরকম কিছু আমল তুলে ধরা হলো।

১. ঋণ পরিশোধে অবকাশ দেওয়ার প্রতিদান
নবীজি (স.) বলেছেন, তোমাদের আগের উম্মতের এক ব্যক্তির রুহের সঙ্গে ফেরেশতারা সাক্ষাৎ করে জিজ্ঞেস করলেন, বিশেষ কোনো সৎকাজ তুমি করেছ কি? সে বলল, না। তারা বললেন, মনে করে দেখো! সে বলল, আমি মানুষের সঙ্গে লেনদেন করতাম। তারপর অসচ্ছল ব্যক্তিদের সুযোগ দিতে ও সচ্ছল ব্যক্তিদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করতে আমি আমার লোকদের নির্দেশ দিতাম। নবী করিম (স.) বলেন, এরপর আল্লাহ তাআলা বললেন, ওকে ছেড়ে দাও। (মুসলিম: ৩৮৮৫)

২. জীবজন্তুর উপকারের প্রতিদান
জীবজন্তুর উপকার করার প্রতিদান অনেক বড়। নবীজি (স.) বলেন, (পূর্ব যুগে) ‘জনৈক ব্যক্তি একটি কুকুরকে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় ভেজা মাটি চাটতে দেখতে পেয়ে তার মোজা নিল এবং কুকুরটির জন্য কুয়া থেকে পানি এনে দিতে লাগল যতক্ষণ না সে ওর তৃষ্ণা মেটাল। আল্লাহ এর বিনিময় দিলেন এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করালেন।’ (বুখারি: ১৭৩)

৩. রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেয়ার প্রতিদান
অনেক সময় রাস্তা-ঘাটে ক্ষতিকর বিভিন্ন জিনিস পড়ে থাকতে দেখা যায়, যা ছোট হলেও তা দ্বারা মানুষের বা আল্লাহর কোনো মাখলুকের ক্ষতি হতে পারে। তা রাস্তা থেকে সরিয়ে ফেলা হয়ত আমাদের জন্য তেমন কোনো কষ্টকরও নয়। কিন্তু আল্লাহর কাছে এর বিরাট প্রতিদান রয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘এক ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে চলার সময় কাঁটাযুক্ত গাছের একটি ডাল রাস্তায় পেল, তখন সেটাকে রাস্তা থেকে অপসারণ করল, আল্লাহ তার এ কাজকে কবুল করলেন এবং তাকে মাফ করে দিলেন।’ (বুখারি: ২৪৭২)

৪. মানুষের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলার প্রতিদান
আসলে কোনো আমলই ছোট নয়। মহান আল্লাহ কোন কাজে খুশি হয়ে যাবেন বলা যায় না। হয়তো মহান আল্লাহ ছোট একটি আমলের ওসিলায় সারাজীবনের সব গুনাহ মাফ করে দেবেন! আবু জার (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবীজি (স.) আমাকে বলেছেন, ‘কোনো নেক আমলকে তুচ্ছ মনে করো না, এমনকি হোক সেটা ভাইয়ের সঙ্গে হাসিমুখে সাক্ষাৎ দেওয়া।’ (মুসলিম: ৬৫৮৪)

৫. নামাজের পর মসজিদে একটুখানি বসার প্রতিদান
নবীজি (স.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যতক্ষণ তার সালাতের স্থানে থাকে তার অজু ভঙ্গ না হওয়া পর্যন্ত তার জন্য ফেরেশতারা এই বলে দোয়া করে যে হে আল্লাহ, আপনি তাকে ক্ষমা করুন, হে আল্লাহ, আপনি তাকে রহম করুন। আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তির সালাত তাকে বাড়ি ফিরে যাওয়া থেকে বিরত রাখে, সে সালাতরত আছে বলে পরিগণিত হবে।’ (বুখারি: ৬৫৯)

৬. অল্প সময় রোগী দেখার প্রতিদান
নবীজি (স.) বলেছেন, কোনো ব্যক্তি রোগী দেখতে গেলে আকাশ থেকে একজন আহ্বানকারী তাকে ডেকে বলেন, তুমি উত্তম কাজ করেছ, তোমার পথ চলা কল্যাণময় হোক এবং তুমি জান্নাতে একটি বাসস্থান নির্ধারণ করে নিলে। (সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৪৪৩)

৭. গুনাহ হয়ে গেলে দ্রুত তাওবা করার প্রতিদান
দ্রুত তওবা করা জান্নাতি মানুষের বৈশিষ্ট্য। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করা হয়েছে, ‘আল্লাহ তাদেরই তওবা কবুল করেন, যারা না জেনে মন্দ কাজ করে, তারপর অচিরেই তওবা করে। এদেরই তওবা আল্লাহ কবুল করেন। আল্লাহ মহাজ্ঞানী প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা নিসা: ১৭) আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা কখনো কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে কিংবা কোনো মন্দ কাজে জড়িত হয়ে নিজের ওপর জুলুম করে ফেললে, আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া আর কে পাপ ক্ষমা করবে? তারা নিজেদের কৃতকর্মের জন্য হঠকারিতা প্রদর্শন করে না এবং জেনে-শুনে তা-ই করতে থাকে না। তাদের জন্য প্রতিদান হলো তাদের পালনকর্তার ক্ষমা ও জান্নাত, যার তলদেশে প্রবাহিত হচ্ছে প্রস্রবণ-যেখানে তারা থাকবে অনন্তকাল। যারা সৎ কাজ করে তাদের জন্য কতই না চমৎকার প্রতিদান।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৩৫-১৩৬)

৮. ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিশোধ না নেওয়ার প্রতিদান
প্রিয়নবী (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের ক্রোধ চরিতার্থ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা সংবরণ করে, আল্লাহ তাকে কেয়ামতের দিন সমগ্র সৃষ্টির সামনে ডেকে আনবেন এবং জান্নাতের যেকোনো হুর নিজের ইচ্ছামতো বেছে নেওয়ার অধিকার দান করবেন।’ (ইবনে মাজাহ: ৪১৮৬)

৯. মা-বাবার দিকে অনুগ্রহের নজরে তাকানোর প্রতিদান
হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন কোনো অনুগত সন্তান নিজের মা-বাবার দিকে অনুগ্রহের নজরে দেখে, আল্লাহ তাআলা তার প্রতিটি দৃষ্টির বিনিময়ে একটি করে কবুল হজের সাওয়াব দান করেন।’ (বায়হাকি-মেশকাত, পৃষ্ঠা-৪২১)

১০. শিরক না করার প্রতিদান
যারা আল্লাহর সঙ্গে শরিক করে না, আল্লাহ তাদের ক্ষমা করার ঘোষণা দিয়ে হাদিসে কুদসিতে বলেন, ‘হে আদম সন্তান, তুমি যদি পৃথিবী পরিমাণ গুনাহ নিয়ে আমার কাছে আসো এবং আমার সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক না করে থাকো, তাহলে আমিও সমপরিমাণ ক্ষমা নিয়ে তোমার কাছে আসব।’ (সুনানে তিরমিজি: ৩৫৪০)

১১. গরিব-দুঃখির পাশে থাকার প্রতিদান
মহানবী (স.) বলেন, ‘দয়াশীলদের ওপর দয়াময় আল্লাহ দয়া করে থাকেন। তোমরা জমিনবাসীদের ওপর দয়া করো, আসমানবাসী (আল্লাহ) তোমাদের ওপর দয়া করবেন।’। (তিরমিজি: ১৯২৪; আবু দাউদ: ৪৯৪১) নবী (স.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সাহায্যে থাকবে, আল্লাহ তার সাহায্যে থাকবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তাকে কেয়ামতের দিনে একটি বড় বিপদ দূর করে দেবেন।’ (বুখারি: ২৪৪২; মুসলিম: ২৫৮০)

১২. আল্লাহর ভয়ে একটুখানি কান্নার প্রতিদান
রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, যে মুমিনের দু’চোখ থেকে আল্লাহর ভয়ে পানি বের হয়, যদি তা মাছির মাথার পরিমাণও হয় এবং তা চেহারা বেয়ে পড়ে, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম হারাম করে দেন। (ইবনে মাজাহ, কিতাবুজ জুহুদ: ৪১৯৭)

১৩. আজান শুনে দোয়া-দরুদ পড়ার প্রতিদান
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যখন তোমরা মুয়াজ্জিনকে আজান দিতে শুনবে, তখন সে যেরূপ বলে, তদ্রূপ বলবে। এরপর আমার ওপর সালাত পাঠ করবে; করণ যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার সালাত পাঠ করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে ১০ বার সালাত (রহমত) প্রদান করবেন। এরপর আমার জন্য অসিলা চাইবে, কারণ অসিলা জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থান। আল্লাহর একজন মাত্র বান্দাই এই মর্যাদা লাভ করবেন এবং আমি আশা করি আমিই হব সেই বান্দা। যে ব্যক্তি আমার জন্য অসিলা প্রার্থনা করবে, তাঁর জন্য শাফায়াত পাওনা হয়ে যাবে।’ (সহিহ মুসলিম: ১/২৮৮, হাদিস নং: ৩৮৪)

১৪. অজুর পর কালেমা শাহাদাত পড়ার প্রতিদান
অজুর পর যে ব্যক্তি ‘আশহাদু আল্লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু লা-শারিকা লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু।’ পড়ে, সে জান্নাতের আটটি দরজার যেকোনো দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে। (সহিহ মুসলিম: ৪৪১, হাদিস একাডেমি, পবিত্রতা অধ্যায়)

১৫. জোহরের ৮ রাকাত সুন্নত পড়ার প্রতিদান
আমবাসা বিন আবু সুফিয়ান (রহ.) বলেন, আমি আমার বোন উম্মে হাবিবা (রা.)-কে বলতে শুনেছি, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি জোহরের আগে চার রাকাত এবং পরে চার রাকাত (সুন্নত) পড়বে আল্লাহ তাআলা তার দেহ জাহান্নামের জন্য হারাম করে দেবেন। (মুসনাদে আহমদ: ২৬৭৬৪(হাদিসটি সহিহ); সুনানে নাসায়ি: ১৮১২)