যে প্রজ্ঞা বা চেতনা মানুষকে তার আপন অবস্থান, কর্তব্য, ভূমিকা পালনের ক্ষমতা এবং সামগ্রিকভাবে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে এই জগত্ জীবনে তার পূর্ণত্বলাভের অভেদ সত্তা দান করে তাইই মূল্যবোধ। এই পৃথিবীতে আগমনের হেতু এবং সে অনুযায়ী তার করণীয় ইত্যাকার বিষয়ের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা, উপলব্ধির সামগ্রিক রূপ হল মূল্যবোধ। সুতরাং দৈনন্দিন জীবনের আদান-প্রদান উপলক্ষ করে মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত চলাচলে যে আদর্শ বা উদ্দেশ্য ফুটে ওঠে, তাতেই রয়েছে তার মূল্যবোধের পরিচিতি। মানবমনে মূল্যবোধ জাগ্রত করতে, তাদের ব্যক্তিগত কিংবা সমষ্টিগত দৈনন্দিন জীবনযাপনে আদর্শ স্থাপনে, উদ্দেশ্য নির্ধারণে ধর্মই অবিসংবাদিত ভূমিকা পালন করে থাকে।
কেননা ধর্ম বলতে বাইরে এমন এক শক্তিকে বোঝায়, মানুষের বিশ্বাস বোঝায় যা দ্বারা সে তার প্রসূত চাহিদা মেটাতে চেষ্টা করে, জীবনের স্থিতিশীলতা হাসিল করতে সক্ষম হয় এবং যা উপাসনা ও জনকল্যাণ সাধনের মাধ্যমে প্রকাশ লাভ করে থাকে। ধর্মীয় মূল্যবোধ মানুষের জীবনে প্রতিমুহূর্তে গাইড হিসেবে কাজ করে, জীবন সমস্যার সমাধান দানে ব্রতী হয়ে আদর্শ জীবন নির্মাণে অনুপ্রেরণা সঞ্চারী ও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে। যুগ বিবর্তনের সাথে সাথে নাস্তিকতাপুষ্ট সমাজবাদের ফলে মানুষের নৈতিক ভিত্তি শিথিল হয়ে পড়ে, জীবন যাত্রায় দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা এবং অশান্তি। মানবচিত্তের বিশ্বাসপুষ্ট প্রকাশই তার ব্যত্তিত্বকে বর্তমান জীবনে অগ্রগতির সহায়ক ও ভবিষ্যত্ জীবনে প্রতিষ্ঠার বাহন রূপে গড়ে তুলতে পারে। এ থেকে একথাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সেই ধর্মই মূল্যবোধ সৃষ্টিতে সহায়ক যা প্রগতিশীল এবং যা মানব জীবনের সামগ্রিক দিক সম্বন্ধে গভীরভাবে অধ্যয়ন করে জীবন বিধান দিতে সচেষ্ট হয়। ইসলামই হল সেই কাঙ্ক্ষিত ধর্ম— যা একটি বিশদ জীবনসংহিতা বলে বিবেচিত। মানব সৃষ্টির আদি থেকে যে জীবন ব্যবস্থা মানবজাতিকে মুক্তির বারতা ঘোষণা করে এসেছে জীবন যাপনে একটা উত্কৃষ্ট পন্থা বদলে দিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এসেছে এবং যার পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটেছে হযরত মোহাম্মদ (স.)-এর হাতেই। ইসলাম এমন একটি ধর্ম যা বিশেষভাবে মানবকল্যাণে নিবেদিত, মানুষের মানসিক ও আধ্যাত্মিক যাবতীয় কতক নির্দেশ ও নিষেধাজ্ঞা জারি করে তার পূর্ণত্ব লাভে সহায়তা করে। এই সমস্ত নির্দেশ ও নিষেধাজ্ঞা সমূহই একটি পূর্ণাঙ্গ সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় পর্যবসিত হয়েছে। বস্তুত ইসলাম একটি শান্তিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা বিনির্মানে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে যার ফলে জীবন সংগ্রামে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে না, অস্তিত্বের সংগ্রামে সে বরং আনন্দ লাভ করে এবং সামগ্রিক ব্যাপারে ইসলামের মহান শিক্ষা তাকে মুক্তবুদ্ধির বোধি দান করে।
ইসলাম গোড়াতেই মানবজীবনকে দেখেছে পূর্ণভাবে। সে জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রবৃত্তি বা জ্ঞানের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে তারতম্য করলেও কোনোটাকেই অস্বীকার করেনি। মানব প্রকৃতির স্বাভাবিক বিকাশের পথ সুগম করার জন্য ইসলামি জীবনদর্শনে মানবজীবনের বৈচিত্র গোড়াতেই স্বীকৃত হয়েছে। ইসলামে একথাও স্বীকৃত হয়েছে যে, মানবজীবনকে সুস্থ, সবল ও স্বাভাবিকভাবে বিকশিত করে তুলতে হলে, তার জৈব জীবনের নানাবিধ প্রবৃত্তির সুস্থ বিকাশ তার পক্ষে অতীব প্রয়োজনীয়। তার লক্ষ্য হবে পূর্ণ মানুষ সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ। তার নৈতিক আদর্শ হবে পরস্পর ভিন্নমুখী প্রবৃত্তির সামঞ্জস্য বিধান। তার সামাজিক ও রাষ্ট্রিক আদর্শ হবে ব্যষ্টি ও সমষ্টির অধিকারের সমন্বয়। সে পূর্নাঙ্গ জীবন দর্শনের অপর নাম ইসলাম। ইসলামকে তাই বলা হয় মানবতার ধর্ম। ইসলাম নির্দেশিত জীবনব্যবস্থা তাই একদিন ধূসর মরুর বুকে বর্বর আরব জাতির সমাজ জীবন থেকে এক বিশাল মানবগোষ্ঠীর কাছে বরণীয় হয়েছিল এবং সামগ্রিকভাবে এটাও প্রমাণিত হয়েছিল যে, এই জীবনদর্শনের ভিত্তি কোনো বায়বীয় ধারণাপ্রসূত নয় কিংবা নয় অলৌকিক কিছু। পাশববৃত্তির হিংস্র বলয় থেকে মানুষকে মুক্ত করে নৈতিকতা বিধানের যে স্বর্ণ সকালের উদ্বোধন ইসলাম করেছে মানবজাতির ইতিহাসে তা এক যুগান্তকারী বিস্ময়। ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হও। ইসলামি মূল্যবোধের সারবস্তু হল আল্লাহর প্রতি কর্তব্যের ধারণ আর মুসলিম জীবনব্যবস্থার সর্বপ্রধান সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য এই যে, এতে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের প্রতিই সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়ে থাকে। সমাজের উন্নতি নিহিত রয়েছে বদান্যতা, ভালোবাসা এবং পরস্পরকে বোঝার ক্ষেত্রে উন্নতি সাধনের তথা নিয়ত পরিবর্তনশীলতা ও সদা বিলীয়মান বস্তুসামগ্রীর ওপর মানুষকে আত্মসচেতন হতে উদ্বুদ্ধ করে আর এই আত্মসচেতনতা থেকে উত্সারিত হয় তার দায়িত্ববোধ এবং তা পালনের একাগ্রতা। চিন্তা থেকে কাজের উত্পত্তি হয়। কাজের পরিকল্পনা অনুযায়ী তার ফল নির্ধারিত হয়। ইসলাম সব সময়ই প্র্যাকটিকাল উইজডমের ওপর জোর দেয়।
ইসলাম কখনো বাইরের থেকে আইন চাপিয়ে আত্মবিকাশে উদ্বুদ্ধ করে না বরং অন্তর থেকে জাগ্রত উপলব্ধিই সেই ভূমিকা পালন করে থাকে। সঙ্গত কারণেই ব্যক্তিসত্তার স্বীকৃতি এবং তার যথার্থ বিকাশের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে ইসলাম। আপন মর্যাদার স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মানুষ নিজেকে প্রকৃষ্টভাবে গড়ে তোলার আমোঘ বিধান পেয়েছে ইসলামের কাছ থেকে। ব্যষ্টিকে নিয়ে সমষ্টি। ব্যক্তি কল্যাণ থেকে উত্সারিত হয় ইসলামের সমাজ কল্যাণমূলক কর্মসূচি। কোনো ভ্রান্ত ধারণার কিংবা আদর্শের ওপর ভিত্তি করে নয় বরং মানুষের মানসিক-শারীরিক চাহিদার কথা স্বীকার করে নিয়ে সামাজিক সংঘবদ্ধতার স্বার্থে ব্যক্তিগত তথা সমষ্টিগত উত্কর্ষতা লাভের ব্যাপারে উত্সাহিত করে। পরস্পরের প্রতি হক আদায় ও কর্তব্য পালনের নির্দেশ, ভালো কাজের নির্দেশ, মন্দ কাজের নিষেধ, নিজের উদ্বৃত্ত অভাবগ্রস্তর মধ্যে বিলি করে অর্থনৈতিক জীবনে সমতা বিধানের নির্দেশ, শ্রমের মর্যাদা দান এবং গায়ের ঘাম শুকাবার আগে পারিশ্রমিক পরিশোধ করার বিধানসহ যাবতীয় ব্যাপারে সুস্পষ্ট ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামের। সহনশীলতা, সাম্যবাদ, ঐক্য ও দেশপ্রেমগত আদর্শের বানী প্রচার করে ইসলাম সমাজ জীবনকে করে তোলে ঐশ্বর্যমন্ডিত। মানব জীবনযাত্রার প্রেক্ষিতে ইসলামের এই যুক্তিনিষ্ঠ নির্দেশাবলী ও কর্মসূচির জন্যেই ইসলাম শ্রেষ্ঠ ধর্ম। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. টয়েনবি বলেছেন- আমরা যে যুগে বাস করছি সে যুগের সমস্যা সমাধানে ঐতিহ্যবাহী ধর্মগুলো কী ভূমিকা পালন করে তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। ধর্মের কাছে বড়ো দাবি হল সমতা বিধানের দাবি। একথা সুস্পষ্ট যে, সাম্যবাদের ধর্ম ইসলামে সামগ্রিকভাবে সমতা বিধানের সুস্পষ্ট নীতিমালা রয়েছে।