৫২ ভাষা আন্দোলন ও মওলানা ভাসানী প্রসঙ্গ

// আজিম উল্যাহ হানিফ
১৯৫২ ভাষা আন্দোলনে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ছিলেন প্রথম কাতারে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ব্রিটিশ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। স্বাধীনতার আগেই পাকিস্তান নামক নতুন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা নিয়ে দেশের শিক্ষিত সমাজ ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণির একটি ক্ষুদ্র অংশ যে নীরব প্রশ্নের সম্মুখীন হন, তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৪৮ সালে ছাত্র যুবসমাজের মধ্যে। পাকিস্তানের ৫৬ ভাগ মানুষের মুখের ভাষা বাংলাকে অগ্রাহ্য করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার শাসকগোষ্ঠীর প্রস্তাবের প্রতিবাদ করে ওঠে পূর্ব বাংলার সচেতন ছাত্র যুবসমাজ।
উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট, পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের দিনও মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আসামের কারাগারে কারারুদ্ধ ছিলেন। নভেম্বরে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি পূর্ব বাংলায় প্রত্যাবর্তন করেন। অনেক স্বপ্ন আর আশা নিয়ে তিনি ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ টাঙ্গাইলের একটি আসন থেকে মুসলিম লীগ প্রার্থী হিসেবে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। এরই মধ্যে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের দাবি উঠতে থাকে বিভিন্ন মহল থেকে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকায় হরতাল পালিত হয়। হরতাল চলাকালে পুলিশি নির্যাতনে অসংখ্য মানুষ হতাহতের পাশাপাশি শামসুল হক, শেখ মুজিব, অলি আহাদসহ প্রায় ৬৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে ২৯ ফেব্রুয়ারিতেও অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। প্রতিবাদে ১৫ মার্চ থেকে শুরু হওয়া প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভার বাজেট অধিবেশনে উত্তপ্ত আলোচনা হয়। অধিবেশনে ভাষার প্রসঙ্গে আলোচনা করেন- ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মওলানা ভাসানী, খাজা নাজিমউদ্দিন, ড. প্রতাপচন্দ্র গুহ রায়, প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী, মনোরঞ্জন ধর, ডা. এএম মালিক, আবু তায়েব মাজহারুল হক, মফিজউদ্দিন আহমদ, শামসুদ্দিন আহমদ, মাহমুদ আলী, মহিউদ্দিন আহমদ, আনোয়ারা খাতুন, এ কে ফজলুল হক, মোহাম্মদ রুকুনুদ্দিন প্রমুখ।আন্দোলনের শুরুটা সীমাবদ্ধ ছিল ছাত্র ও যুবসমাজের মধ্যেই। ভাষা আন্দোলনের বিষয়টি রাজনৈতিক নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় অনেক সময় পরে। অনেক রাজনৈতিক নেতা ভাষা আন্দোলনের শুরুতে জড়িত ছিলেন। ভাষা সম্পর্কে ছাত্রদের দাবিতে নাজিমউদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বলেন যে, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। প্রদেশের ভাষা কী হবে তা প্রদেশবাসীই স্থির করবেন, কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।’
ওই সভায় তিনি মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখেন। মওলানা ভাসানী সম্পর্কে তিনি যা বলেন তার অর্থ-মওলানা ভাসানীর সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ রয়েছে এবং তিনি একজন ‘ভারতের চর’। খাজা নাজিমউদ্দিনের এই অভিযোগের প্রতিবাদে দুই নেতাই পত্রপত্রিকায় বিবৃতি প্রদান করেন। মওলানা ভাসানী তার দীর্ঘ বিবৃতিতে বলেন, “যেভাবে আজ দেশের সমস্ত জনসাধারণ মুসলিম লীগ শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হইয়া এবং যখন পায়ের নিচ হতে ক্রমেই মাটি সরে পড়ছে তখন খাজা নাজিমউদ্দিনের পক্ষেই বেসামাল হয়ে আমার এবং সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে আবোল তাবোল অভিযোগ আনায়ন করা কিছুমাত্র আশ্চার্যের ব্যাপার নহে।
তথাকথিত মুসলিম লীগওয়ালাদের বিগত চার বছরের কুশাসনে দেশ চরম দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্যের নিম্নস্তরে নামিয়া গিয়াছে। খাজা নাজিমউদ্দিন তাহাদের সব দোষত্রুটি ঢাকিবার জন্য বৃথাই আমাদের প্রতি গালিগালাজ বর্ষণ করিবার অপচেষ্টা করিয়াছেন।.আমি বর্তমান মুসলিম লীগওয়ালাদের মতো মনে করি না যে, ভারতের মুসলমানদের প্রতি আমাদের কোনো দায়িত্ব নাই। পাকিস্তানের প্রতি আমাদের দেশপ্রেমের জন্য খাজা নাজিমউদ্দীনের সার্টিফিকেটের প্রয়োজন পড়ে না। এ দেশের জনসাধারণ ভালো করিয়াই জানেন যে, বিগত ১৯৪৬ সালে যখন পাকিস্তান ইস্যুর ওপর নির্বাচন হয় তখন আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি থাকিয়াও যখন জাতির সেই ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের নির্বাচনে জয়লাভ করিবার জন্য উত্তরবঙ্গে আমি প্রাণপণে কাজ চালাইয়া যাইতেছিলাম খাজা নাজিমউদ্দিনের তখন সুদূর আমেরিকায় এবং তাহার বর্তমান অনুচরবর্গের অনেকেই তখন হয়তো কংগ্রেস নতুবা ব্রিটিশের অধীনে চাকরিরত।”
ভাষা আন্দোলনে করণীয় নির্ধারণে বায়ান্নর ৩১ জানুয়ারি ঢাকার বার লাইব্রেরিতে সর্বস্তরের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এক সাধারণ সভায় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। এ সভায় যে ৪০ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয় সেখানে ছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে প্রধান করে এবং আবুল হাশিম, আতাউর রহমান খান, কামরুদ্দীন আহমেদ, খয়রাত হোসেন, আনোয়ারা খাতুন, শামসুল হক, আবুল কাশেম, আবদুল গফুর, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, মীর্জা গোলাম হাফিজ, আবদুল মতিন, কাজী গোলাম মাহবুব, শামসুল হক চৌধুরী, খালেক নেওয়াজ খান, সৈয়দ আবদুর রহিম  উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দ। সেই সভাতেই ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রাভাষা কমিটির পূর্ব ঘোষিত ৪ ফেব্রুয়ারির ঢাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট এবং ওই দিনের সভা ও শোভাযাত্রার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম অন্যতম সংগঠক অলি আহাদ লিখেছেন, ‘৬ ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ কর্মী অফিস ১৫০ মোগলটুলিতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সরকার যদি ১৪৪ ধারা ইত্যাদি নিষেধাজ্ঞা জারি করে তাহা হইলে আইন ভঙ্গ করা হইবে কি হইবে না তাহাও আলোচিত হয়। বেশির ভাগ উপস্থিত সদস্যই আইনভঙ্গের বিপক্ষে মত দেন। কিন্তু আমি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে দৃঢ় মত প্রকাশ করি। বৃদ্ধ মওলানা ভাসানীর আসন হইতে আমার বক্তব্যের সমর্থনে জোরালো ভাষায় ঘোষণা করিয়া বলেন যে সরকার আমাদের নিয়মতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ গণ-আন্দোলনকে ইচ্ছাকৃতভাবে বানচাল করিবার জন্য অন্যায়ভাবে আইনের আশ্রয় গ্রহণ করে। সে সরকার কর্তৃক জারিকৃত নিষেধাজ্ঞাকে মাথা নত করিয়া গ্রহণ করিবার অর্থ স্বৈরাচারের নিকট আত্মসমর্পণ। যা হোক, কোনোরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ব্যতীতই সেই দিনকার সভা মূলতবী করা হয়।’ (জাতীয় রাজনীতি-৪৭-৭৫)।
ভাষা সৈনিক অলি আহাদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে বক্তব্য রেখেছিলেন। তাকে সমর্থন জানিয়ে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, যে সরকার গণআন্দোলনকে বানচাল করার জন্য অন্যায়ভাবে আইন প্রয়ােগ করে সে সরকারের জারি করা নিষেধাজ্ঞাকে মাথা নত করে মেনে নেয়ার অর্থ স্বৈরাচারের কাছে আত্মসমর্পণ করা। মওলানা ভাসানীর এই দৃঢ় অবস্থানের ফলে আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। ২১ ফেব্রুয়ারি সর্বাত্মক ধর্মঘটের কর্মসূচি ঘােষিত হয়।পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে এক মাসের জন্য সব মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে।২১ ফেব্রুয়ারি হরতালকে সফল করার জন্য ৪ ফেব্রুয়ারি থেকেই প্রস্তুুতি চলতে থাকে। ঠিক সেই সময় অর্থাৎ ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এক মাসের জন্য ঢাকায় সর্বত্র ১৪৪ ধারা জারি করে। সর্বমহলেই সরকারের এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ওই রাতেই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময়টা মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী মফস্বল সফরে ছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সভায় সরকারের জারিকৃত ১৪৪ ভঙ্গের ব্যাপারে সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের মধ্যে তুমুল বাগবিতন্ডা হয়। অলি আহাদ পরিস্থিতি ব্যাপক ও সুস্পষ্ট বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আন্দোলনের অগ্রসর না হলে ভাষা আন্দোলনের এখানেই অনিবার্য মৃত্যু ঘটবে। আর সরকারি দমননীতির কাছে বশ্যতা স্বীকার করা হবে ও জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রাম চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। পরিশেষে সভায় ১১-৪ ভোটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন অলি আহাদ, আবদুল মতিন (ভাষা মতিন),

শামসুল হক ও গোলাম মাওলা। যাই হোক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দোদুল্যমানতা সত্ত্বেও ছাত্র-যুবসমাজের আপসহীন প্রচেষ্টায় বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি রচিত হলো এ দেশের সংগ্রামের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের মাধ্যমেই সূচনা হয় ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত অধ্যায়। যে অধ্যায়ে সালাম, বরকত, রফিকসহ বহু শহীদের রক্তে লেখা হয় ইতিহাস।ব্যাপক রক্তপাতের কথা শুনেই মজলুম জননেতা ভাসানী ছুটে আসেন ঢাকায়। সরকার এতটা হিংস্র হতে পারে সে আশঙ্কা আগে কেউ করেনি। পরদিন ভাষা শহীদদের স্মরণে যে গায়েবানা জানাজা হয় মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে মওলানা ভাসানী তাতে উপস্থিত ছিলেন। এ সম্পর্কে ভাষাসৈনিক মোহাম্মদ সুলতান বলেছেন, ‘মওলানা ভাসানী গায়েবি জানাজা পরিচালনা করেন।’ ভাষাসৈনিক গাজীউল হক বলেন, ‘শহীদদের গায়েবি জানাজা হলো। মোনাজাত করলেন মওলানা ভাসানী।’ ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক লিখেছে, ‘মেডিকেল কলেজের সম্মুখে তিনি (মওলানা ভাসানী) লক্ষ লোকের একটি গায়েবি জানাজার নেতৃত্ব করেন।’ ২১ ফেব্রুয়ারির ভয়াবহ ও বর্বরোচিত ঘটনা সম্পর্কে মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ঢাকায় যাহা ঘটিয়াছে তাহাকে নিন্দা করার ভাষা আমার নাই। কোনো সভ্য সরকার এরূপ বর্বরোচিত কান্ড করিতে পারে আমি দুনিয়ার ইতিহাসে তার নজির খুঁজিয়া পাই না। বেশি কথা বলার সময় এটা নয়। আমি দাবি করি, অবিলম্বে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হোক। পুলিশি গুলির তদন্ত করার জন্য হাইকোর্ট জজ ও জনপ্রতিনিধি নিয়া গঠিত কমিশন নিযুক্ত করা হোক। আমি অপরাধীদের প্রকাশ্যে বিচার দাবি করিতেছি। এই ব্যাপারে যাদের গ্রেফতার করা হইয়াছে তাদের মুক্তি দেয়া এবং যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হইয়াছে অবিলম্বে তাহা প্রত্যাহার করা হোক। সর্বোপরি শহীদদের পরিবার পরিজনকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হোক।’আন্দোলনকে স্তিমিত করতে শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক নেতাকর্মী, সংস্কৃতিকর্মীসহ অসংখ্য ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছিল সরকার। যাদের মধ্যে অন্যতম হলেন-মওলানা ভাসানী, আবুল হাসিম, মাওলানা তর্কবাগীশ, শামসুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, আবদুল মতিন, কাজী গোলাম মাহবুব, খয়রাত হোসেন, খান সাহেব ওসমান আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী, অজিত গুহ, খালেক নেওয়াজ খান, মির্জা গোলাম হাফিজ, সরদার ফজলুল করিম প্রমুখ। সেই বন্দিজীবন সম্পর্কে ভাষা আন্দোলনের সিপাহসালার অলি আহাদ লিখেছেন, ৫নং ওয়ার্ডে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আবুল হাসিম, শামসুল হকৃ ও আমি একত্রে বাস করিতাম। সর্বপ্রকার আশানিরাশার আলো-ছায়ার খেরায় বৃদ্ধ মওলানা ভাসানী সকলের নিকট পিতৃতুল্য স্নেহ, মায়া মমতা এবং সাহস, উৎসাহ ও দৃঢ়তার মূর্ত প্রতীক ছিলেন। আমাদের খাওয়া-দাওয়া ও ঔষুধপত্রের যাহাতে অসুবিধা না হয় তাহার জন্য তিনি জেল কর্তৃপক্ষের সুকৌশলে জয় করিয়া রাখিতেন। মোদ্দাকথা তাহার অপত্যস্নেহ ও নির্ভীক মন সেই সময়ে দুর্লভ প্রেরণার উৎস ছিল।’ (জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫)।
সেই সময়কার ভাষা আন্দোলনকারীসহ বিভিন্ন কারাগারে বন্দি কমিউনিস্ট নেতা ও বামপন্থীকর্মীদের মুক্তির জন্য বিদ্রোহ করেন মওলানা ভাসানী। এ প্রসঙ্গে ভাষা আন্দোলনের সিপাহসালার অলি আহাদ তার জাতীয় রাজনীতিতে ১৯৪৫-৭৫ বইয়ে লিখেছেন, ‘রাজবন্দির মুক্তির ও অন্য দাবিতে মওলানা ভাসানী লেবু রস পানে রোজা রাখিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আমরাও বন্দিমুক্তি ও কতিপয় দাবির ভিত্তিতে পূর্ণ অনশন ধর্মঘটের পরিবর্তে মওলানা ভাসানী পরামর্শমতো ৩৫ দিন অনুরূপ রোজা রাখি।’ মওলানা ভাসানী ৫৩-এর ১৮ এপ্রিল থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারে আর রোজার মতো নয় সম্পূর্ণ ‘আমরণ অনশন ধর্মঘট’ শুরু করেন, তাতে সরকার বিচলিত হয়, কারণ তার অনশনের সংবাদ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। এমনিতেই কারাবারণের সময় মওলানা ভাসানীর শারীরিক অবস্থা ক্রমান্বয়ে অবনতি ঘটতে থাকে। ৫৩-এর ফেব্রুয়ারিতে মওলানা ভাসানীকে কয়েক দিনের জন্য চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে রাখা হয়েছিল। সেই সময় ২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম বর্ষপূর্তিতে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে জেলখানায় এক দিনের অনশন করেন। সেদিন তিনি এক ফোঁটা পানিও মুখে দেননি। অনশন ধর্মঘট শুরুর পর তার অবস্থার অবনতি ঘটলে এবং ব্যাপক জনমতের চাপে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ১৯৫৩-এর ২১ এপ্রিল কারাগার থেকে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন।
১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ সালের মধ্যে ক্রমে জোরাল হয়ে উঠে বাংলা ভাষার মর্যাদা আদায়ের দাবি। ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ ও সাধারণ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত হয়। পাকিস্তান সরকার আন্দোলন দমন করার জন্য ১৪৪ ধারা জারির মাধ্যমে জনসমাগম, জনসভা ও মিছিল নিষিদ্ধ করে দেয়। ছাত্ররা সংগঠিতভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে পুলিশ গুলি চালায়। শহিদ হন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিউর, অহিদসহ আরও অনেকে।পরদিন সারা রাত জেগে শহিদদের স্মরণে গড়া হয় শহিদ মিনার। পুলিশ তা ভেঙে ফেললে আবারও গড়ে ওঠে শহিদ মিনার। ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তায় জন্ম নিয়েছিল একুশের চেতনা। এই চেতনা আমাদের জাতীয় জীবনে আত্মত্যাগের বীজমন্ত্র।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ব্যাপক জয়লাভের পর ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মওলানা ভাসানী, মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার ও শহীদ বরকতের মা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানের ২১৪ (১) অনুচ্ছেদে বাংলা রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায়। এরপর ১৯৬২ সালের সংবিধানে বলা হয়, পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হবে বাংলা ও উর্দু। ১৯৭২ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। ২০০০ সালের  ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর রুপকার ছিলেন কুমিল্লার কৃতি সন্তান বীরমুক্তিযোদ্ধা মো: রফিকুল ইসলাম।
এভাবেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন মওলানা ভাসানী। সেকালের আরাে অনেক নেতাও প্রাথমিক পর্যায়ে অংশ নিয়েছিলেন কিন্তু তাদের সবাইকে শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তৎকালীন সময়ে  এ বিষয়ে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম ছাত্রনেতা গাজীউল হক জানিয়েছেন, মওলানা ভাসানীসহ যে ৪২ জন নেতা এই আন্দোলনের সপক্ষে ছিলেন তাদের মধ্যে প্রভাবশালী কয়েকজন মন্ত্রিত্ব ও রাষ্ট্রদূতের পদ নিয়ে আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেন।

লেখক: আজিম উল্যাহ হানিফ- (সাবেক সভাপতি জাতীয় ছাত্র মৈত্রী কেন্দ্র, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ।)  কবি ও কলামিস্ট