নজরুল ইসলাম তোফা
মানুষের নৈতিকতাবোধ লুপ্ত হয়ে গেছে, মূল্যবোধ চলেই গেছে। ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং হিংসা বা লোভ গ্রাস করছে গোটা সমাজকে। মানুষের প্রতি সব মানুষের গভীর ভালোবাসা, কর্তব্যবোধ কিংবা সহানুভূতি দিনের পর দিন কমে যাচ্ছে। শুধুই যেন তারা স্বার্থপরতার অন্ধকারেই হাবুডুবু খাচ্ছে। একজন মানুষ তার চরিত্রকে দৃঢ় থাকতে অপারগ। তার কারণটা হলো, যেকোনো অবস্থা মোকাবিলা করতেই অক্ষম। ব্যর্থ হয়ে মানুষ শুধু মানুষের প্রতি হিংসাই করে। তাই বলতেই হয় হিংসা একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি। এমন ব্যাধিটা অবশ্যই ক্ষতিকর। হিংসা সামাজিক বন্ধনগুলোর মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করে এবং মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট করে। প্রতিপক্ষকে অস্ত্র, সন্ত্রাস এবং কু-কৌশলে হিংসা দ্বারা ঘায়েল করা নয়, নিজ কর্মের মাধ্যমে সব মানুষের মন জয় করা প্রয়োজন। ডনজুয়ান বলেছেন যে, ‘হিংসা দিয়ে কখনো হিংসাকে হত্যা করা যায়না। অবশ্য আগুন নেভাতে যেমন পানির প্রয়োজন হয়, তেমনি হিংসাটাকে জয় করতে প্রেমের প্রয়োজন’। হিংসা করলে যেন তার প্রতিদানে শুধুই হিংসা পাওয়া যায়। আর প্রেম করলেও পাওয়া যায় প্রেমানন্দ। সৎ লোকেরা কখনোই পর নিন্দা ও নিজের প্রশংসা করে না। যে নিজ কর্মের প্রতি বিশ্বাস করতে পারে, সেই মানুষই অর্জন করতে পারে। পরিশ্রমী ব্যক্তিদেরকে অলসব্যক্তি এবং অল্পবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিরা শুধুই যেন হিংসা করে। পিটার উইসটিনভের মতামতের আলোকে বলা যায় যে, যুগ যুগ ধরে যারা মানুষের ভুল বা হিংসা করার উদ্দেশ্য খুঁজে বেড়ায়। সেগুলোর দ্বারাই যেন একদিন তাদের চরম মূল্য দিবে এবং শেষে অবশ্য তারা টেরও পেয়ে যাবে। যে হিংসা করে সে সবার আগে তো নিজের ক্ষতি করে। সৃষ্টিকর্তা বা আল্লাহর জমিনেই সর্ব প্রথমে যে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটেছিল তার মূলেই ছিল ‘হিংসা’। এই প্রসঙ্গটির উদৃতি পবিত্র কুরআনে সূরা মায়েদার ২৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে। সুতরাং- হিংসা করে খারাপ সমালোচনার দিকে মন দেওয়াটা ঠিক নয়। আবার জ্যাক ওয়ার্নার বলেছেন যে, আজকের খবরের কাগজ অবশ্যই তা কালকের ‘টয়লেট পেপার’। সুতরাং- আজকের যুগের নিন্দুক ব্যক্তি কিংবা মানুষ, কালকের পোকামাকড়। এমন এই পোকামাকড় কামড়ায় শুধুমাত্র হিংসার কারণে নয়, নিজকে বাঁচানো প্রয়োজনে। একই কথা নিন্দুক ও হিংসুক সমালোচকের জন্যেও প্রযোজ্য হবে। তারা কখনো মানব জাতির মঙ্গল কামনা করে না, চেষ্টা করে বেদনা এবং আঘাত দেওয়ার কঠিনতর ইস্যু খোঁজে। ‘আব্রাহাম লিঙ্ক’ও বলেছেন, সমালোচনা করার অধিকার তারই আছে, যার সাহায্য করার মতো হৃদয়টা আছে। তাই- হিংসুক ব্যক্তিরা স্থায়ী কষ্টেই ভোগে। এমন কারণে হিংসুকব্যক্তিরা মনোদৈহিক রোগে যেন আক্রান্ত হয়। আল্লাহকে চেনা, ভালো মানুষকে চেনা ও সঠিক বা সত্যকে উপলব্ধি করা, মারেফাত এবং আধ্যাত্মিকতার পথে হিংসার কঠিন হিজাব অথবা পর্দা’র মতো আড়াল তৈরি করে। হিংসুক ব্যক্তি সবাইকেই হিংসা করে থাকে, এমন কি নিজের আপন জনদেরকেও না বুঝেই ‘হিংসা’ করে। ফলে সে সকল হিংসুকরা বন্ধুবান্ধব হারাতে বাধ্য হয়। হিংসুক ব্যক্তিরা কখনো উচ্চ ও মহৎ পর্যায়ে যেতে পারে না। শেখ সাদী (রহ.) বলেন, যে সৎ হয় নিন্দা তার কোন অনিষ্ট করতে পারে না। নিন্দুকেরা নিন্দাটা করেই যাক এতে তারই ক্ষতি হয়। যে কোনো মানুষ প্রশংসনীয় আচরণ করবে, আবার হিংসাটাও করবে তাতো হয় না। তাই তো- আল হাদিসের আলোকে বলতেই হয়, ”ঈমান এবং হিংসা এক সঙ্গে একই অন্তরে থাকতে পারে না”।
নৈতিকতার একটি ঘৃণ্য ও নিন্দনীয় কাজই হলো হিংসা। হযরত আলী (রাঃ) বলেন, নীচ লোকের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে- “অশ্লীল বাক্য আর হিংসা” করা। যদিও মানুষদের হিংসার সাথে কমবেশি সাক্ষাৎ ঘটে। প্রকৃত ঘটনা হলো, সকল মানুষ চেষ্টা করে অন্যের চেয়ে এগিয়ে থাকতে বা নিজেকে তুলনামূলকভাবেই বড়ো বা যোগ্যতরো অথবা শ্রেষ্ঠ থেকে শ্রেষ্ঠতরো ভাবা। অপর মানুষদের চেয়ে- কী করে অনেক বেশি অর্জন, উপার্জন কিংবা আহরণ করা যায় সে চিন্তা না করেই যেন শুধু মগ্ন থাকে হিংসা নিয়ে। মানুষের ভেতরে এই যে নেতিবাচক এক প্রতিযোগিতার চিন্তা এটাই ‘মানসিক সৌন্দর্যের সর্ববৃহৎ অবক্ষয়’। তাই ইতিবাচক অনুভূতির গোড়ায় গলদ নিঃসন্দেহে। কেননা এ অনুভূতি আছে বলেইতো মানুষ চেষ্টা তদবির চালায়, পরিশ্রম করে এবং বিচিত্র কর্মকাণ্ডে নিজেকেই জড়ায়। পক্ষান্তরে, মানব জাতির মধ্যে অনেকেই ভালো মানুষও রয়েছে, যারা অপরের ভালো কিছু সহ্য করে নেয়। অন্য মানুষের ভালো কিছু দেখলে মন খারাপ করে না। তাকে উৎসাহ যুগিয়ে থাকে। কেউবা তা প্রকাশ করেই জানান দেয় মঙ্গল হোক। সুতরাং তিনিই হিংসুটে মানুষ নিজকে শ্রেষ্ঠতর মানুষ হিসেবে দাবি করে। অন্যের ভালো থাকা এবং সুখে থাকা তিনি মেনে নিতেই পারে না। কিন্তু এমন হিংসা করাটা মূলত একধরনের বৃহৎ পাপ, আবার তারা জানেও না এটা ভয়ানক ব্যাধি। রাবেয়া বসরী বলেছেন, ‘পরশ্রীকাতর ও লোভী ব্যক্তি কখনো শান্তি পায় না।’
হিংসা বিদ্বেষ মানুষকেই জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। হিংসার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধর্ম সহ পবিত্র কোরআনে শক্ত অবস্থান আছে। কোরআনের মধ্যেই সূরা ফালাকে ঘোষণাও আসে তাহলো,- ‘’আর হিংসুকের অনিষ্ট থেকে পানাহ চাই, যখন সে হিংসা করে।” হযরত আলী (রাঃ)ও বলেছেন যে,- ‘সুস্থ থাকার জন্য হলেও হিংসা পরিত্যাগ করো, কেননা হিংসা মানুষকে ভিতর হতে গলিয়ে দেয়”। নষ্ট করে দেয় আত্মাকে। দিনে দিনেই যেন মানুষ অসুস্থ ও অশুদ্ধ ব্যক্তির কাতারে পড়ে। অন্যদিকে যাকে হিংসা করে তার সাময়িক ক্ষতি হলেও সেখানে অহেতুক সময় নষ্ট করার প্রয়োজন নেই। “লোকে হিংসা করছে মানেই, আপনি উন্নতি করছেন। কিন্তু যেমুহুর্তে হিংসাকে গুরুত্ব দিতে শুরু করবেন, অবনতির রাস্তা খুলে যাবে। কে কি ভাবছে- তা নিয়ে মাথা ঘামালে নিজের কাজটা করবেন কখন। আলী ইবনে আবু তালিব (আঃ) তাঁর সু- চিন্তিত মতামতের আলোকে বলেন, ‘যে ব্যক্তি ধৈর্যধারণ করতে পারবে, সে কখনো সফলতা থেকে বঞ্চিত হবে না। তাই সফল হবার জন্য তার একটু বেশি সময় লাগতে পারে।’ সুতরাং অপছন্দ ও অন্ধকার মনে হওয়া ব্যক্তিদের এবং আলোকিত ব্যক্তিদের কখনোই গাল-মন্দ করা যাবে না। নিজ থেকে ছোট্ট একটি বাতি জ্বালানোই উত্তম। কেননা দেখাও যায় যে নিজ কর্মে প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং পরিশ্রমী না হয়ে নিন্দুক ব্যক্তিরাই যেন- অন্যের কর্মের প্রতি হীন মনমানসিকতা, ঈর্ষাপরায়ণতা বা সম্পদ পাওয়ার মোহ, পদমর্যাদার লোভ-লালসা অথবা হিংসা-বিদ্বেষের মতো অনেক নেতিবাচক কর্মকান্ড করে থাকে। হিংসা-বিদ্বেষ মুমিনের সৎ কর্ম ও পুণ্যকে তার একান্ত অজান্তেই কুরে কুরে খায়। এই মানুষকেই হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, শঠতা-কপটতা, অশান্তি ও হানাহানি ইত্যাদি সামাজিক অনাচারের পথকে পরিহার করেই পারস্পরিক ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনেই যেন আবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। ইসলাম সহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের প্রতিই মানুষের পরিশীলিত জীবনবোধ সৃষ্টি করে নিজকে গড়ে তোলা উচিত। এসব বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মানুষদেরই মুল কথা, উক্তি বা বাণী। হিংসা সমাজ জীবন এবং কর্ম জীবনেই অনেক অশান্তি বয়ে আনে। মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে। সৃজনশীল কর্ম কান্ডকে ব্যহত করে। ‘আমল ও ঈমান’ ধ্বংস করেই কুফরের দিকে নিয়ে যায়। হিংসা কারো জীবন ও মনের মাঝে প্রবেশ করানো উচিত নয়। মানব চরিত্রে যে গুলো খারাপ দিক আছে, তার মধ্যেই হিংসা-বিদ্বেষ মারাত্মক ক্ষতিকারক। ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, ঈর্ষাকাতরতা কিংবা কলহ-বিবাদ প্রভৃতি মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবনকেই যেন অত্যন্ত বিষময় করে তোলে। এতে করেই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি- মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। অন্যের সুখ-শান্তি ও ধন-সম্পদ বিনষ্ট এবং ধ্বংস করে।
পরিশেষে বলা যায়, পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা সতর্ক বার্তা দিয়েই পৃথিবীর মানুষের মধ্যে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষের পরিবর্তে সামাজিক শান্তি, সম্প্রীতিকে বজায় রাখার উদ্দেশ্য তুলে ধরেছেন। (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৫৪) ‘’আল্লাহ পাক নিজ অনুগ্রহে মানুষদেরকে যা দিয়েছেন, সেই জন্যেই কি তারা ঈর্ষা করে?’ ইসলাম আসলেই অন্যের প্রতি হিংসা করা ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হওয়াকে সম্পূর্ণরূপে হারাম ও নিষিদ্ধ করেছে। সুতরাং সিংসা তারাই করতে পাবে, যাদের মানুষের জন্য ভালো কিছু করার কোনো যোগ্যতা নেই। আর কখন যে কোন মানুষকে কার দরজায় দাঁড় করাবে তা কোনো মানুষও টের পারেনা, শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তার নিয়ন্ত্রণে হয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের অমানুষিক খারাপ আচরন কিংবা হিংসা করা উচিৎ নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিংসাকে নিয়ে বলেন, তোমরা পরস্পরকে হিংসা করো না, একে অপরের সাথে কোনো সম্পর্কচ্ছেদও করোনা, একজন আরেক জনকেও কখনো ঘৃণা করো না। বরং- আল্লাহ তাআলার বান্দা হিসেবেই- পরস্পরের ভাই হও। হিংসার পরিণতি হলো দুঃখ এবং হতাশা। কেননা সকল মানুষের উল্লেখ যোগ্য অর্জন বা নিয়ামত প্রাপ্তিটাই যেন হিংসুক ব্যক্তির অন্তরে ঈর্ষা, হতাশা ও কষ্টের জন্ম দেয়। এতে এক সময় সেই মানুষরাই কঠিন মর্মপীড়ায় ভুগতে থাকে। তাদের দেখা দেয় নানাধরনের শারীরিক সমস্যা। আবার যখন কোনো মানুষ, অন্য মানুষের প্রতি ঈর্ষাতুর হয়, তখন সে আল্লাহ তায়ালা’র প্রজ্ঞাকেই সন্দেহ করে। আল্লাহর বিভিন্ন নির্দেশ এবং সিদ্বান্ত’কে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সৃষ্টিকর্তা কাকে কোন নিয়ামত দিবেন কিংবা কার প্রতি কতটুকু দয়া দেখাবেন, তা একান্তই তাঁর নিজ ইচ্ছাধীন। তারপরও হিংসুক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী মানুষরা চায় ঈর্ষাকৃত ব্যক্তি কর্তৃক উপভোগকৃত নিয়ামতটি যেন হারিয়ে যায়। তারা চায় নিজে তা উপভোগ করতে। তারা পারুক আর নাইবা পারুক, ঐসব অর্জন ও নিয়ামতকে ভোগ করার উপযুক্ত হোক বা না হোক। তাই বিখ্যাত মনীষীদের সত্য বাণী এবং উক্তির আলোকে জীবনযাপন করলে হয়তো হিংসাকে দূূূর করে খুব সুন্দর জীবন গড়ে তোলা সম্ভব।হিংসা থেকে বাঁচার জন্যেই যেন উত্তম আচরণ ও পবিত্র অন্তরের অধিকারী হতে হবে। অন্যমানুষদের যে কোনো কিছু অর্জন কিংবা উপভোগ করেছে, সে নিয়ামতটাকে নিজের জন্যেই প্রত্যাশা করার অনুমতি আছে। তবে এই শর্তে যে, উপভোগকারী কোনো ব্যক্তির নিকট থেকে তা কেড়ে নেওয়া হোক এমনটা প্রত্যাশা করা ঠিক নয়। সৃষ্টি কর্তার দেওয়া নিয়ামত বা সুফল অন্যকেউ শ্রম দিয়ে তা নিজের করে ভোগ করুক, তাও অন্যকে অপছন্দ এবং হিংসা করে নয়। মানুষের উচিত, সৃষ্টি কর্তা অন্যকেই কী দিয়েছে, সেটা নিয়ে কু-চিন্তা ও হিংসা না করে তাকে যে সব গুণাবলি কিংবা নেয়ামত দিয়েছে, সেইগুলোর কথা চিন্তা করা এবং প্রয়োজনে তা গণনা করেই নিজ জীবন কর্মে প্রতিফলন ঘটানো। অহেতুক আত্ত্বদম্ভ, পরচর্চা বা হিংসা করে নয়। আমিত্ত্ব বা নিজস্বতাকে প্রতিষ্ঠিত করে চেতনাকে জাগ্রত উচিত। জাতীয় কবি- “কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ওরা প্রচার করুক হিংসা বিদ্বেস আর নিন্দাবাদ, আমরা বলব সাম্য শান্তি আর এক আল্লাহ জিন্দাবাদ।
লেখক:- টিভি ও মঞ্চ অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, কলামিষ্ট এবং প্রভাষক।