। আমিরুল ইসলাম রাঙা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য সহযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও পাবনা সদর আসনের সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন পাবনায় সুপরিচিত এক রাজনীতিবীদ। পাবনায় সর্বমহলে পরিচিত আওয়ামী লীগ নেতা আমজাদ হোসেনকে নিয়ে কথা বলতে হলে প্রশ্ন উঠে কোন আমজাদ মিয়া? পাবনায় আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন দুইজন আমজাদ হোসেন। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে দুইজন একসাথে রাজনীতি করতেন। একজন বড় আমজাদ আর আরেকজন ছোট আমজাদ। বড় আমজাদ হোসেন পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। দুইবার পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের এমএনএ ছিলেন। ছোট আমজাদ হোসেন পেশায় আইনজীবী ছিলেন এবং স্বাধীনতার পর প্রথম সংসদ নির্বাচনে এমপি হয়েছিলেন। বড় আমজাদ হোসেন ১৯৭১ সালে ৬ এপ্রিল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরন করেন। ছোট আমজাদ হোসেন স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর ২০১৫ সালের ২২ মার্চ এই পৃথিবী থেকে চীরবিদায় নেন।
এ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন ১৯৩২ সালের ১ জানুয়ারী নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার ভোঁপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা এস এম হেফাজ উদ্দিন এবং মাতা মোচ্ছাম্মত আজিজা খাতুন। আমজাদ হোসেন নিজগ্রাম ভোঁপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা জীবন শুরু করেন। এরপর নওগাঁ শহরে হাই মাদ্রাসা থেকে ১৯৪৯ সালে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর কিছুদিন রাজশাহী পড়াশুনা করে বাবার কর্মস্থল পাবনায় চলে আসেন। বাবা এস এম হেফাজ উদ্দিন পাবনা সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংকে চাকুরী করতেন। আমজাদ হোসেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯৫২ সালে আইএ পাশ করেন। ১৯৫৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিএ পরীক্ষা দিয়ে নবম স্থান অধিকার করেন। ১৯৫৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৮ সালে আইনজীবী হিসেবে পাবনা জজ আদালতে যোগ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন।
১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন পরবর্তী তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের অগণতান্ত্রিক কর্মকান্ডে রাজনৈতিক অঙ্গন ক্রমেই বিরুপ হয়ে উঠে। ১৯৫৩ সালে কয়েকজন বন্ধু মিলিত হয়ে নবগঠিত পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রব বগা মিয়া সহ প্রমুখ নেতাদের সাথে পরামর্শ করে পাবনায় প্রথম জেলা ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করেন। পাবনা জেলা ছাত্রলীগের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন, আলতাফ হোসেন ( শাহজাদপুর) এবং সাধারন সম্পাদক হন মোঃ শামসুজ্জোহা ( কুষ্টিয়া)। ১৯৫৩ সালে মাওলানা আব্দুল হামিদ ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাবনায় আসেন। মুলত তখনই নেতাদের সাথে আমজাদ হোসেনের পরিচয় হয়। একসময়ে আমজাদ হোসেন রাজশাহী বিভাগে ছাত্রলীগের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পান।
এ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন ১৯৫৩ সালে পাবনা স্টেডিয়ামে মুসলিম লীগের সম্মেলন বানচাল আন্দোলন, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে প্রচারনা, ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন বাতিলের আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৭ সালে ভুট্টা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালে গণ-আন্দোলনে সক্রিয় ভুমিকা পালন করেন। ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত অনেকবার কারাগারে যেতে হয়। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে প্রায় আট বছরের বেশি সময় জেলখানায় বন্দী ছিলেন।
এ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পাবনা মটর শ্রমিক সমিতির সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাবনা এডরুক শ্রমিক সমিতির সভাপতি ছিলেন। ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের শ্রম ও সমাজকল্যান সম্পাদক ছিলেন। আইন পেশায় ১৯৭২ – ৭৪ সালে জিপি ছিলেন। ১৯৯২ সাল ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত পর পর দুইবার বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে পাবনার অন্যতম সংগঠক ছিলেন। ১৯৭১ এর ২৭-২৯ মার্চ পাবনায় সংগঠিত প্রতিরোধ যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ২৯ মার্চ পাবনা হানাদার মুক্ত হলে স্থানীয় স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্তে ২ এপ্রিল অগ্রগামী প্রতিনিধি দল হিসেবে পাবনার ন্যাপ নেতা রণেশ মৈত্র এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি কুষ্টিয়ার আলী রেজা সহ ভারত গমন করেন। তাঁরা ভারত সরকারের সহযোগিতা কামনা করে তৎকালীন নাচোলের নারীনেত্রী ও ভারতের সংসদ সদস্য ইলা মিত্রের মাধ্যমে উর্ধতন মহলে যোগাযোগ করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রবাসী সরকারের সিদ্ধান্তে পশ্চিম দিনাজপুর জেলার বালুঘাটের মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্পের সহকারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করেন। উল্লেখ্য এ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন ঐ অঞ্চলে থাকার অন্যতম প্রধান কারন হলো, আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী নওগাঁর আবদুল জলিল তাঁর খালাতো ভাই এবং স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু তাঁর চাচাতো ভাই। তাঁদের অনুরোধে এ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেনকে বালুঘাটে থাকতে হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে ২৪ ডিসেম্বর তিনি নওগাঁ হয়ে পাবনা প্রত্যাবর্তন করেন।
এ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন তাঁর জীবনে দুটি জিনিষকে ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। এক পাবনার মাটি এবং দুই আওয়ামী লীগের রাজনীতি। সে শত প্রলোভনে পাবনা ত্যাগ করে নাই। এই প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দেওয়া যায় ১৯৭৩ সালের ঘটনা। প্রথম সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু তাঁকে নওগাঁর আত্রাই থেকে প্রার্থী করতে চেয়েছিলেন। এই বিষয়ে তাঁর ভাই আবদুল জলিল, প্রথম রাজনৈতিক গুরু ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী জাতীয় নেতা এইচ এম কামরুজ্জামান চেয়েছিলেন আমজাদ হোসেন এমপি হোক। উনাদের অনুরোধ বিনয়ের সাথে প্রত্যাখান করে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, আমি নওগাঁর মানুষের নেতা হতে চাইনা। আমি পাবনার মানুষের কর্মী হয়ে থাকতে চাই। বঙ্গবন্ধু একথা শুনে খুব আবেগ আপ্লুত হয়েছিলেন। ১৯৫৩ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু আমজাদ হোসেনকে কি পরিমাণ ভালবাসতেন তা কাছের মানুষেরা জানতেন। ৫৪ সালের যুক্তফন্ট নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু আমজাদ হোসেনকে নিয়ে দেশের বহু জেলায় সফরসঙ্গী করেছেন। বড় বড় সমাবেশে আমজাদ হোসেনকে দিয়ে গান গাওয়াতেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে আদর করে আমজেদ বলে ডাকতেন। আমজাদ হোসেন বঙ্গবন্ধুকে অনেকবার নাম বিকৃত করে না বলার কথা বললেও বঙ্গবন্ধু আমজেদ বলে ডেকে অট্টহাসি দিতেন।
এ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন পাবনার এক বিরল রাজনৈতিক নেতা। উদার মনের এই মানুষটি খুব হাসিখুশি থাকতেন। মনটা ছিল শিশুর মতন। অথচ ব্যক্তিত্ব, সততা আর নীতি ছিল আকাশ ছোয়া। লোভ লালসা কখনো আক্রমণ করতে পারে নাই। তিনি হলেন একমাত্র নেতা যিনি কখনো দলের কোন গ্রুপিং এ অংশ নিতেন না। আওয়ামী লীগ যেখানে উনি থাকতেন সেখানে। উনার নীতি ছিল আওয়ামী লীগ।আর নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এর বাইরে আর কিছু উনি ভাবতেননা। উনার দলীয় পদপ্রাপ্তি বা ক্ষমতার লিপ্সা কোনদিনই গ্রাস করতে পারে নাই। এই প্রসঙ্গে ছোট্ট একটি উদাহরণ হলো ১৯৭৩ সালে ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম সংসদ নির্বাচন। দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য অনেকে আবেদন করেছেন। সেবার দলীয় মনোনয়ন পান, পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুর রব বগা মিয়া। সাধারণ সম্পাদক সহ সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা ক্ষুব্ধ হয়ে জনৈক এক নেতাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাড় করেছিলেন। উল্লেখ যোগ্য প্রায় সব নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে। সিনিয়র নেতাদের মধ্যে এ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ছিলেন। নির্বাচনের মাত্র ১২ দিন আগে ২৫ ফেব্রুয়ারী জীপগাড়ি দুর্ঘটনায় প্রার্থী আব্দুর রব বগা মিয়া মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরন করেন। জীপগাড়িতে থাকা এ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন গুরুত্বভাবে আহত হন। অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলেও তাঁর পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে যায়।
১৯৭৩ সালের ৭ মার্চের নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। দুর্ঘটনার পর বঙ্গবন্ধু পাবনায় আসেন। দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করার অপরাধে পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক সহ ১১ জন শীর্ষ নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৭৩ সালের ৪ এপ্রিল উপ-নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়। দলীয় প্রার্থী হিসেবে এ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেনের নাম ঘোষণা করা হয়। আহতবস্থায় হাসপাতালের চিকিৎসাধীন অবস্থায় এ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টে বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হলে তিনি মোশতাক সরকারের সাথে যোগদান না করার অপরাধে তাঁকে জেলে যেতে হয়।
এ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ১৯৬৬ সালে শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে চীন সফর করেন। ১৯৭৩ সালে ১৩ নভেম্বর চিকিৎসার জন্য রাশিয়া যান। উনি বাংলাদেশ – সোভিয়েত ইউনিয়ন মৈত্রী সমিতির পাবনা জেলা সভাপতি ছিলেন। ১৯৮৯ সালে সৌদি আরব যান এবং হজ্জ পালন করেন। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে একাধিকবার ভারত সফর করেন।
তাঁর সহধর্মিণী অধ্যাপিকা জান্নাতুল ফেরদৌস ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত পাবনা-সিরাজগঞ্জ সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি ছিলেন। পারিবারিক জীবনে তাঁদের এক ছেলে দুই মেয়ে। বড় মেয়ে শিরীন ফেরদৌস রাখী অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর। তিনি পল্লী উন্নয়ন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ছিলেন। বর্তমানে অবসরে আছেন। তাঁর স্বামী ডাঃ আলতাফ হোসেন মন্ডল পাবনা মানসিক হাসপাতাল ও বগুড়া মেডিকেল কলেজে কর্মরত ছিলেন। ছেলে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা নৌপ্রকৌশলী ড. সাজিদ হোসেন রুশো। ২০০৯ সাল থেকে অদ্যাবধি চট্টগ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির কমান্ড্যান্ট হিসেবে কর্মরত আছেন। ছোট মেয়ে ডাঃ শাহিন ফেরদৌস শানু ( এমবিবিএস) পাবনার প্রখ্যাত গাইনী চিকিৎসক। তাঁর স্বামী ডাঃ আহমেদ আরিফ পরাগ একজন চিকিৎসক।
এ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেনের পাবনার গোপালপুর মহল্লার নির্ঝর ভবনটি ছিল স্থায়ী নিবাস। পাবনা মহিলা কলেজ, পাবনা আইন কলেজ, শহীদ সাধন সঙ্গীত মহাবিদ্যালয় সহ বহু প্রতিষ্ঠান গড়ার সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। পাবনার রাজনৈতিক অঙ্গনের সুপরিচিত মিষ্টভাষী, সৎ এবং আদর্শবান এই নেতা ২০১৫ সালের ২২ মার্চ মাত্র ৮৩ বছর বয়সে এই পৃথিবী থেকে চীরবিদায় নিয়েছেন। ( সমাপ্ত)
লেখক পরিচিতি –
আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।
২২ মার্চ ২০২০
তথ্য সুত্র –
১. এ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন এর লেখা
আত্মজীবনীমুলক গ্রন্থ ” বিস্মৃত প্রায় “।
২. এ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন এর পুত্র
নৌপ্রকৌ. ড. সাজিদ হোসেন রুশো।