বাংলাদেশের খ্যাতিমান কবি বন্দে আলী মিয়া স্মরণে

/ এবাদত আলী কলমিলতার কবি, ময়নামতির চরের কবি, পাবনা শহরের উপকন্ঠ রাধানগর মহল্ল¬ার কবি কুঞ্জের কবি বন্দে আলী মিয়া আমাদের মাঝ থেকে চির দিনের জন্য হারিয়ে গেলেও তার সাধনার ফসল, জীবন বোধের বান্তব অভিজ্ঞতার আলোকে রচিত ছড়া, কবিতা, গান আজো বাংলাদেশের মানুষের হ্রদয়ে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। কবি কুঞ্জের পশ্চিম পাশে চিরতরে কবি ঠাঁই করে নিয়েছেন। বেছে নিয়েছেন জীবন যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাবার আনন্দলোকের পথ। বাংলাদেশের খ্যাতিমান শিশু সাহিত্যিক কবি বন্দেআলি মিয়া ১৯০৬ সালের ১৭ জানুয়ারি পাবনা শহরের রাধানগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম উমেদ আলী মিয়া। মাতার নাম নেকজান নেছা। ১৭ বছর বয়সে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন এবং ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমীতে ভর্তি হন। ৪ বছর ধরে তিনি আর্ট শিক্ষা করেন। তার শিশুদের জন্য রচিত প্রথম ছড়া ও কবিতার বই প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। ঐ সময় থেকে তার লেখা কবিতা ও ছড়া ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি গেজেট পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তার জীবন কালের প্রায় ৫০ বছরই তিনি সাহিত্য চর্চায় কাটিয়েছেন। কবি বন্দে আলী মিয়া ছিলেন শিশুদের কবি। কেমন করে শিশুদের মন লেখনীর মাধমে আনন্দে ভরে তোলা যায় এটাই ছিলো তার মূলত সাধনা। বাস্তব ক্ষেত্রেও তিনি শিশু সুলভ মন নিয়েই ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের সাথে প্রায়ই হাসি ঠাট্টা করতেন। প্রখ্যাত সাহিত্যিক শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশা তখন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে অধ্যাপনা করতেন এবং রাধানগর খেদমতগার সমিতির পূর্ব দিকের একটি বাসাতে থাকতেন। সময় সুযোগ পেলেই কবি বন্দে আলী মিয়া তার বাসায় যেতেন এবং সাহিত্য সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করতেন। এ ছাড়া এডওয়ার্ড কলেজের অধ্যাপক হাসানুজ্জামান, অধ্যাপক ইদরিস আলী, অধ্যাপক হাবিবুন্নবীর সাথেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিলো অত্যাধিক। কবি বন্দেআলী মিয়া ছিলেন সরল প্রকৃতির। দাম্ভিকতা বা আত্মঅহংকার তার মাঝে ছিলোনা। শিশু সাহিত্যে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য তিনি প্রেসিডেন্ট পুরুষ্কার লাভ করেন। তার অধিকাংশ রচনা ছিলো শিশুদের উপযোগি করে লেখা। তার রচনাবলীর মধ্যে চোর জামাই, দুই বন্ধু, ঝিনুক পরি,যেমন কর্ম তেমন ফল, কুচবরন কন্যা, ডাইনী বৌ, গুপ্ত ধন, শিশুদের বিষাদ সিন্ধু, বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা, শিয়াল পন্ডিতের পাঠশালা ইত্যাদি সুখপাঠ্য। তার বৌদি রেষ্টুরেন্ট ও গাধা হাকিম নাটক সবিশেষ উলে¬খযোগ্য। তার প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত বই ৬০ খানা। শিশুদের জন্য প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিদের জীবনীও তিনি লিখেছেন। কবি বন্দেআলী মিয়ার সব চেয়ে উলে¬খযোগ্য কাব্য গ্রন্থ ময়নামতির চর। ময়নামতির চর কাব্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখতে গিয়ে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন“ তোমার ময়নামতির চর কাব্য খানিতে পদ্মাচরের দৃশ্য এবং তার জীবন যাত্রার প্রত্যক্ষ ছবি দেখা গেল। পড়ে বিশেষ আনন্দ পেয়েছি। তোমার রচনা সহজ এবং স্পষ্ট, কোথাও ফাঁকি নেই। সমস্ত ঘরের অনুরাগ দিয়ে তুমি দেখেছো এবং কলমের অনায়াস ভঙ্গিতে লিখেছো। তোমার সুপরিচিতি প্রাদেশিক শব্দ গুলি যথাস্থানে ব্যবহার করতে তুমি কুন্ঠিত হওনি। তাতে করে কবিতা গুলি আরো সরস হয়ে উঠেছে। পদ্মাতীরের পাড়া গাঁয়ের এমন নিকট স্পর্শ বাংলা ভাষায় আর কোন কবিতায় পেয়েছি বলে মনে পড়ছেনা। বাংলা সাহিত্যে তুমি আপন বিশেষ স্থানটি অধিকার করতে পেরেছো বলে আমি মনে করি। ২৬ জুলাই,১৯৩২ ।’’ তার ৯ খানা কাব্য ১০ খানা উপন্যাস, ৩ খানা ছোট গল্প, ১১ খানা নাটক এবং সঙ্গীত ভিত্তিক ২ খানা রচনা রয়েছে। এ ছাড়া তার “জীবনের দিনগুলি’’ একটি বিশেষ রচনা। কবি বন্দেআলী মিয়া বেশি জাক জমক পছন্দ করতেন না। এমনকি তার লেখার জন্য ভাবুক মনে ভাবের অভাব হতোনা। ১৯৬৬ সালে পাবনা থেকে সাহিত্য পত্রিকা ‘‘দিগন্তিকা’’ প্রকাশের প্রাক্কালে আর্শীবাণীর জন্য বন্ধু আবদুস সাত্তারকে আমরা তার কাছে রাজশাহী পাঠিয়ে ছিলাম। কবি তখন বাজার করতে বেরিয়ে পড়েছেন। পথি মধ্যে তাকে আমাদের কথা বলা হলে তিনি রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়েই লিখেছিলেন- নতুন পথের নতুন পথিক তোমার দিগন্তিকা খ্যাতির মাল্য কন্ঠে পরাবে ভালে দিবে জয় টিকা। ( দিগন্তিকা- ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা ১৯৬৬ )।
তিনি জীবনের ঢ়ের সময় কোলকাতা কাটিয়েছেন। ভারতে প্রভাতীসহ অন্যান্য পত্র পত্রিকায় তার প্রচুর লেখা ছাপা হয়েছে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরে প্রথমে তিনি ঢাকায় এবং পরে রাজশাহীতে কর্মরত ছিলেন। 
রাজশাহী বেতারের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্টভাবে জড়িত ছিলেন। ছেলে ঘুমালো অনুষ্ঠানের জন্য তিনি প্রতিদিনই নিত্য নতুন গল্প লিখতেন। রাজশাহীর সর্বস্তরের মানুষ তাকে অত্যাধিক ভালো বাসতেন। কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯৭৯ সালের ২৭ জুন সকাল ১১.২০ মিনিটের সময় তিনি রাজশাহীতে ইন্তেকাল করেন।
চিরাচরিত নিয়মানুসারে তিনি বিদায় নিয়েছেন। তবুও মনে জাগে একবার তার কাছে পত্রিকার জন্য কবিতা চেয়েছিলাম। তিনি পাঠিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে একটি চিঠিও। তিনি লিখেছিলেনÑ বেতার ভবন রাজশাহী ১১/১১/৭৭ “কল্যানীয়েষু” প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়ে পত্র আরম্ভ করছি। পত্রিকাটি কত দিনে প্রকাশিত হচ্ছে। প্রকাশিত হলে পাঠাতে অনুরোধ করছি। দ’ুটি কবিতা পাঠালাম। প্রাপ্ত সংবাদ জানালে বাধিত হব। বন্দে আলী মিয়া।
একটি কবিতার নাম ছিল “বিদায়” তিনি লিখেছিলেন;
                ধরিত্রীর পরমায়ু পলে পলে
                    হয়ে এলো শেষ
                নহে বৃথা জীবনের একটি নিমেষ।
                জনতার এক কোনে ছিল মোর ঠাঁই
                এই কথা মনে লয়ে ফিরে আজ যাই,
                    ফিরে যাই অস্ত পারাবারে
                ফিরে যাই বিধাতার অন্ধকারাগারে।
                শুন্য পাথেয় লয়ে ফিরে চলিলাম
                হানাহানি নাহি যেথা আমি সেথা
                    লভিব বিরাম।
                একটি ক্ষুধিত শ্বাস রেখে গেনু ধরার ধূলায়
                চারিদিকে হাহাকার ধ্বনি
                    গুমরিছে তায়।
                অপরাধ করিয়াছি তোমাদের কাছে
                আমার কত না ভুল- কত ত্রুটি-
                তোমাদের স্মরণেতে আছে।
                ক্ষমা করো বন্ধু হে ভুলে যেও মোরে
                                      আর আমি ফিরিবনা তোমাদের তরে।
                                         (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)
এবাদত আলী সাংবাদিক ও কলামিস্ট সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব তারিখ: ২৬/০৬/২০২৪.