আমজাদ হোসেন একটি নাম – একটি ইতিহাস

// আমিরুল ইসলাম রাঙা :: ভাষা সংগ্রামী ও পাবনায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক আমজাদ হোসেন ১৯৭১ সালের ৬ ই এপ্রিল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দশদিন পর ৬ ই এপ্রিল তাঁর চিরবিদায় হয়েছিল অনেকটা নীরবে। সারা জীবন সরবে কাটিয়ে নীরবে পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার ঘটনা অনেকের কাছে বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যায়। মৃত্যুর ঠিক চার মাস পূর্বে ১৯৭০ সালের ৭ ই ডিসেম্বর পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য অর্থাৎ এম,এন,এ হিসেবে নির্বাচিত হন। ইতিপূর্বে ১৯৬২ সালে প্রথম এম,এন,এ হয়েছিলেন। তাঁর সংসদীয় নির্বাচনী এলাকা পাবনা সদর, আটঘরিয়া ও ঈশ্বরদী। ১৯৭০ সালের ৭ ই ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদ নির্বাচন এবং ১৭ ই ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য অর্থাৎ এমপিএ হিসেবে পাবনা সদর থেকে আব্দুর রব বগা মিয়া, আটঘরিয়া ও ঈশ্বরদী থেকে অ্যাডভোকেট আমিন উদ্দিন, সাঁথিয়া ও বেড়া থেকে আহমেদ রফিক, সুজানগর ও বেড়া থেকে আহমেদ তফিজ উদ্দিন এবং চাটমোহর ও ফরিদপুর থেকে অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক সমাজী নির্বাচিত হন। পাবনায় জাতীয় পরিষদের তিনটি আসন ছিল। এম,এন,এ নির্বাচিত হয়েছিলেন আমজাদ হোসেন, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এবং হোসেন মনসুর। ১৯৭০ সালের ৭ ই ডিসেম্বর এবং ১৭ ই ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর তিন মাসের ব্যবধানে তিনজন সংসদ সদস্য মৃত্যুবরণ করেন। ১৭ ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে সাঁথিয়া বেড়া থেকে নির্বাচিত এম,পি,এ আহমেদ রফিক ২২ শে ডিসেম্বর পাবনা শহরের রাঘবপুরে তাঁর বাড়ির সামনে খুন হয়। এরপর ২৬ শে মার্চ পাকিস্তানি সৈন্যরা আটঘরিয়া ঈশ্বরদী থেকে নির্বাচিত এম,পি,এ অ্যাডভোকেট আমিন উদ্দিনকে তাঁর পাবনা শহরের গোপালপুর বাসভবন থেকে আটক করে। ২৮ শে মার্চ দিবাগত রাতে পাবনা বিসিক এলাকায় পাকিস্তানি সৈন্যরা অ্যাডভোকেট আমিন উদ্দিনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এর এক সপ্তাহের মধ্যে ৬ ই এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন পাবনায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নব নির্বাচিত এম,এন,এ আমজাদ হোসেন। ১৯৭১ এর উত্তাল মার্চ। ১ লা মার্চ পাকিস্তানের সামরিক সরকার জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদ অধিবেশন অনিদিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। এমন ঘোষণায় ক্ষুব্ধ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে গোটা দেশ। ৭ ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এরপর দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। পাবনায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আমজাদ হোসেনকে প্রধান করে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পাবনা পৌরসভা সংলগ্ন আমজাদ হোসেনের বাড়িতে স্থাপিত হয় সংগ্রাম পরিষদের অফিস। ৭ ই মার্চ থেকে ২৫ শে মার্চ পর্যন্ত পাবনায় একদিকে চলেছে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ। অন্যদিকে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে চলে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। ২৫ শে মার্চ দিবাগত রাতে রাজশাহী সেনানিবাস থেকে প্রায় দেড় শতাধিক পাকিস্তানি সৈন্য পাবনা বিসিকে এসে অবস্থান নেয়। ২৬ শে মার্চ পাকিস্তানি সৈন্যরা আওয়ামী লীগ নেতা নবনির্বাচিত এমপিএ অ্যাডভোকেট আমিন উদ্দিন সহ অর্ধ শতাধিক মানুষকে আটক করে। ২৭ তারিখে পাকিস্তানি সৈন্যরা পাবনা পুলিশ লাইন আক্রমণ করে। ২৮ তারিখে পাবনার সর্বস্তরের জনতা পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে। পাকিস্তানি সৈন্যরা ২৮ শে মার্চ দিবাগত রাতে অ্যাডভোকেট আমিন উদ্দিন সহ বেশ কয়েকজনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ২৮ এবং ২৯ শে মার্চ ১৭টি স্থানে খন্ড খন্ড যুদ্ধে পাবনায় আগত সমস্ত পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। ২৯ শে মার্চ থেকে ১০ ই এপ্রিল পর্যন্ত পাবনা হানাদার মুক্ত থাকে। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানি সৈন্যরা পুনরায় আরিচা নগরবাড়ি হয়ে পাবনা প্রবেশের চেষ্টা করে। শুরু হয় নগরবাড়ি ঘাটে মুক্তিকামী জনতার প্রতিরোধ। ইতোমধ্যে পাবনায় সংগ্রাম পরিষদের অফিস আমজাদ হোসেনের বাসভবন থেকে পুরাতন পলিটেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটে স্থানান্তরিত হয়। ৬ ই এপ্রিল সেখানেই অসুস্থ হয়ে পড়েন আমজাদ হোসেন। এরপর তাঁকে পাবনা সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অত্যন্ত প্রতিকুল অবস্থার মধ্যে তাঁর জানাজা শেষে আরিফপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্রয়াত আমজাদ হোসেন ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর। তিনি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পি,এস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ১৯৬২ এবং ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে এম,এন,এ নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৭১ সালে আমৃত্যু পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। আমজাদ হোসেন ১৯২৪ সালে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার চর সদিরাজপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রফিক উদ্দিন এবং মাতা পরিজান নেছা। বাল্যকালেই পিতা-মাতার সাথে জন্মস্থান ছেড়ে পাবনার নুরপুর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। সেখান থেকেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। প্রথমে রাধানগর মক্তব স্কুলে ভর্তি হন। তারপর পাবনা জেলা স্কুলে ভর্তি হয়ে ১৯৪০ সালে মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৪২ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে আই,এ পাশ করে কলকাতা আজাদ কলেজে ভর্তি হন। সেখানে পড়াশোনার সময় পরিচয় হয় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা ফজলুল হক এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে। সেখান থেকেই তাঁর রাজনীতির যাত্রা শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর কলকাতা থেকে পাবনায় চলে আসেন। পাবনায় এসে শুরু করেন ঠিকাদারী ব্যবসা। ব্যবসার পাশাপাশি তিনি রাজনীতি এবং সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ গঠিত হলে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলন শুরু হলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯৪৮ সালে ৫ ই মার্চ পাবনায় ভাষা আন্দোলনের প্রথম সভায় উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকার অপরাধে গ্রেপ্তার হন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর পাবনায় এসে মটর এমপ্লয়ীজ এসোসিয়েশনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তদানিন্তনকালে পাবনায় ঐ সংগঠনটি ছিল বেশ বড় এবং শক্তিশালী। দেশ ভাগের পর ঐ সংগঠনের প্রধান রবি ভট্টাচার্য ভারত চলে গেলে সংগঠনটির দায়িত্ব নেন আমজাদ হোসেন। পরে ক্যাপ্টেন এম, মনসুর আলী সভাপতি এবং আমজাদ হোসেন সাধারণ সম্পাদক হন। পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন এম, মনসুর আলী ঢাকায় গেলে আমজাদ হোসেন ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সংগঠনটির সভাপতি ছিলেন। ১৯৫৭ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে আমজাদ হোসেন তাঁর পি,এস নিযুক্ত হন। প্রায় ৬ মাস নিষ্ঠার সাথে ঐ পদে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙ্গে যায়। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ থেকে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বের হয়ে ন্যাপ গঠন করেন। এর বিরূপ প্রভাব পড়ে পাবনা জেলায়। পাবনার শীর্ষ পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতারা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপে চলে যান। ঠিক সেই সময় পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ক্যাপ্টেন এম, মনসুর আলী কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আওয়ামী লীগে নেতৃত্ব গ্রহণ করলে আমজাদ হোসেন পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন। ঐ একই বছরের জুন মাসে ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হলে আমজাদ হোসেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। এরপর ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আমজাদ হোসেন পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আব্দুর রব বগা মিয়া। প্রয়াত আমজাদ হোসেন রাজনৈতিক জীবনে ভাষা আন্দোলন ও ভুট্টা আন্দোলন সহ বিভিন্ন সময়ে একাধিক বার গ্রেপ্তার হয়ে জেলে গেছেন। আমজাদ হোসেন মৃত্যুকালে স্ত্রী, ১ ছেলে ৫ মেয়ে রেখে যান। একমাত্র ছেলে ফারুক হোসেন ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। সে ১৯৯৫ সালের ১ লা সেপ্টেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মেয়েদের সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিয়ে হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য জামাতারা হলেন ক্যাপ্টেন ডা. ইফতেখার রসুল, বীর মুক্তিযোদ্ধা সাঈদ আকতার ডিডু, ডা. নুরুজ্জামান। স্বাধীনতার পর তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে বালিয়াহালট আমজাদ হোসেন উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া শহরের বাসট্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো আমজাদ স্মরনিকা। যাহা ২০০৭ সালে তত্বাবধায়ক সরকার ভেঙ্গে ফেলেছে। এরপর তাঁর নামে আর কোন উল্লেখযোগ্য স্থাপনা করা হয় নি। কালের বিবর্তনে এই মহান নেতা বিস্মৃতির আড়ালে ঢাকা পড়লেও পাবনার রাজনীতিতে তিনি হলেন অমর, অক্ষয় এবং অবিনশ্বর। লেখক – আমিরুল ইসলাম রাঙা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিবীদ।