বিগত কয়েক দশক ধরেই ইরানে হামলা করার পরিকল্পনা প্রস্তুত করে শাণিয়ে নিয়েছে ইসরায়েল। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে দেশটি ব্যাপক অত্যাধুনিক অস্ত্রও প্রস্তুত করেছে। এরপর সাম্প্রতিক সময়ে দেশটি যখন অন্য দেশের কাছে সমরাস্ত্র বিক্রি করতে শুরু করেছে তখন গিয়ে বিষয়টি জানা গেছে যে, ইসরায়েল আসলে কতটা অত্যাধুনিক অস্ত্র তৈরি করেছে।
গত সেপ্টেম্বরে ইসরায়েলের এফ-১৫ যুদ্ধবিমান নিজ দেশ থেকে ১৮০০ কিলোমিটার দূরে ইয়েমেনে গিয়ে হুতি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। এই হামলার বিষয়টি ইসরায়েলের ‘প্রয়োজন বিবেচনায় উদ্ভাবন’ বা ইম্প্রোভাইজেশন দক্ষতারই ইঙ্গিত দেয়। সাধারণভাবে এফ-১৫ যুদ্ধবিমান তৈরি করা হয়, আকাশে যুদ্ধের জন্য। কিন্তু ইসরায়েল এই যুদ্ধবিমানগুলোকে নিজস্ব প্রযুক্তি দিয়ে আরও শাণিত করে তুলেছে। নতুন নতুন সব অস্ত্র বহনে সক্ষম করে তুলেছে।
তবে ইয়েমেনে হুতি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানো যতটা সহজ ছিল, ইরানের হামলা চালানো ততটা সহজ হবে না। কারণ, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ও ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি উভয়ই মাটির অনেক গভীরে অবস্থিত। তবে দেশটির তেল স্থাপনা তুলনামূলক অরক্ষিত। এ ছাড়া, ইরানের অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও আছে।
ইরানের দাবি, তারা এই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিজেরাই তৈরি করেছে। কিন্তু এখনো সেই অর্থে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কোনো শক্ত পরীক্ষার মুখে পড়েনি। তবে, এই ব্যবস্থাটি রাশিয়ার তৈরি এস-৩০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের সঙ্গে মেলে। সাধারণভাবে, এই ব্যবস্থার ইসরায়েলের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র আটকানোর সক্ষমতা আছে। কিন্তু, গত এপ্রিলে ইসরায়েল যখন ইরানের ইস্পাহানে হামলা চালিয়েছিল তখন এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কোনো এক কারণে সক্রিয় হয়নি। এর বাইরে, ইরানের চার যুগ পুরোনো মিগ-২৯ ও যুক্তরাষ্ট্রের এফ-১৪ মডেলের যুদ্ধবিমান আছে। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার পরও এই যুদ্ধবিমানগুলো সক্রিয় আছে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীতে।
এসব চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখেই ইসরায়েলি প্রতিরক্ষাবাহিনী বিগত ২০ বছর ধরে ইরানে সম্ভাব্য হামলা ছক কষেছে। বিনিয়োগ করেছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ও শেকেল। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে, ইসরায়েল এমন কিছু অস্ত্র তৈরি করেছে নিজস্ব প্রযুক্তি যা যুক্তরাষ্ট্র বিক্রি করতে চায়নি। ইসরায়েলের এসব প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও নেই।
১৮০০ কিলোমিটার দূর থেকে হামলা
রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় দেশগুলো ১৮০০-২০০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার জন্য সাধারণত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র বা বোম্বার বিমান ব্যবহার করে। তবে ইসরায়েল বরং ক্ষেপণাস্ত্র বা বোমারু বিমানের জায়গা থেকে সরে এসে যুদ্ধবিমান দিয়েই এই দূরত্বে হামলা চালানোর সক্ষমতা অর্জন করেছে। দেশটির কাছে এক স্কোয়াড্রন অত্যাধুনিক এফ-১৫ আই ও এফ-১৬ আই এর চারটি যুদ্ধবিমান আছে—যেগুলোকে ইসরায়েল নিজেদের মতো করে বিশেষায়িত করে নিয়েছে। এই যুদ্ধবিমানগুলো যেতে আসতে টানা চার ঘণ্টা আকাশে উড্ডয়ন করতে সক্ষম।
বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিন এমন এক ধরনের ফুয়েল ট্যাংক বানিয়েছে—বিশেষ করে এই বিমানগুলোর জন্য। যার ফলে, এই বিমানগুলো দীর্ঘ উড্ডয়নের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছে। তবে বেশি জ্বালানির জন্য ফুয়েল ট্যাংক তৈরি করা হলেও বিমানগুলোর অ্যারোডাইনামিকস বা রাডারের কার্যক্ষমতায় কোনো পরিবর্তন আসেনি।
বিদেশি গণমাধ্যমগুলোর খবর ইঙ্গিত করে যে, ইসরায়েল নিজের প্রযুক্তিতে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের জন্য বিচ্ছিন্নযোগ্য জ্বালানি ট্যাংক তৈরি করেছে। তবে এরপরও স্টেলথ ক্ষমতা বা নিজেতে গোপন রাখার ক্ষমতা বজায় রেখে ইরানে পৌঁছাতে সক্ষম।
আকাশ থেকে নিক্ষেপণযোগ্য দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইরানে হামলা
একুশ শতকের শুরুর দিকে ইসরায়েল দুটি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র উন্মোচন করে। যেগুলো যুদ্ধবিমান বিমান থেকে নিক্ষেপ করা যায়। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর পাল্লা কতটুকু তা জানা না গেলেও এগুলো যে, ইরানের আকাশসীমায় না গিয়েও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বাইরে থেকে ইসরায়েলকে দেশটিতে শত শত কিলোমিটার দূর থেকে হামলার সুযোগ দেবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সুপারসনিক গতিতে অর্থাৎ শব্দের গতির চেয়েও বেশি গতিতে চলতে সক্ষম। যার ফলে, এগুলোকে ইন্টারসেপ্ট করার সুযোগ কম থাকে এবং লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
র্যাম্পেজ ক্ষেপণাস্ত্র
এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইসরায়েলের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি। ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি এবং দেশটির রকেট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এলবিট সিস্টেমস মিলে এই ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে। প্রাথমিকভাবে এগুলোকে ভূমি থেকে নিক্ষেপের জন্য প্রস্তুত করা হলেও পরে এগুলোকে আকাশ থেকে নিক্ষেপের জন্যও মডিফাই করা হয়। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর পাল্লা বেড়ে গেছে। একাধিক নেভিগেশন সিস্টেম থাকায় এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার সক্ষমতা অনেক বেশি নির্ভুল।
মাত্র ৪ দশমিক ৭ মিটার লম্বা এবং ৩০ দশমিক ৬ সেন্টিমিটার পরিধির এই ক্ষেপণাস্ত্রের ভর মাত্র ৫৪০ কেজি। এ ছাড়া, এগুলো ১৫০ কেজির সমান ভরের বিভিন্ন ওয়ারহেড বহন করতে পারে। গঠনগত কারণে, এর পক্ষে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়া অনেকটাই সহজ। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকে ইসরায়েলের এফ-১৫, এফ-১৬ এবং এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান থেকে নিক্ষেপ করা সম্ভব। এ ছাড়া, দামের দিক থেকেও এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো খুবই সাশ্রয়ী। মাত্র কয়েক শ ডলার খরচ করেই একেকটি র্যাম্পেজ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করা সম্ভব।
রকস ক্ষেপণাস্ত্র
ফরাসি অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রাফালে ২০১৯ সালে রকস ক্ষেপণাস্ত্র প্রথমবার প্রকাশ করে। এই ক্ষেপণাস্ত্রটিকে ‘স্যাটেলাইট নেভিগেশন ও ইনর্শিয়াল নেভিগেশন’ সিস্টেম দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সেই সঙ্গে এর আছে, অপটিক্যাল টার্গেটিং সিস্টেম। যা এটিতে নিজের মতো করে লক্ষ্যবস্তুতে আলাদাভাবে চিনতে সহায়তা করে। এই ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রটির গতিও সুপারসনিক অর্থাৎ শব্দের গতির চেয়ে বেশি। এটি ইরানের শাহাব ক্ষেপণাস্ত্রের মতোই অনেকটা।
এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকে এফ-১৬ এবং এফ-৩৫ এর মতো যুদ্ধবিমান থেকেই নিক্ষেপ করা যেতে পারে। এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ৩০০ কিলোমিটার এবং এগুলো ৫০০ কেজি পর্যন্ত ওয়ারহেড বহনে সক্ষম। যা এটিকে সুরক্ষিত বা ভূগর্ভস্থ কাঠামোকে লক্ষ্যবস্তু করতে সক্ষম করে তোলে।
অন্যান্য অত্যাধুনিক অস্ত্র
বিদেশি সূত্রগুলোর ইঙ্গিত, ইসরায়েলের কাছে সারফেস টু সারফেস বা ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রও আছে। জেরিকো নামে পরিচিত এই ক্ষেপণাস্ত্র পারমাণবিক ওয়ারহেড বহন করতে পারে। তবে ইরান ইসরায়েলে শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করলেও, ইসরায়েল ইরানে হামলার ক্ষেত্রে এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করবে এমন সম্ভাবনা কম। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো মূলত ফ্রান্সের ড্যাসল্ট কোম্পানি তৈরি করেছিল। পরে ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি এগুলোকে নিজেদের প্রয়োজনমতো মডিফাই করে নিয়েছে।
এ ছাড়া, এলবিট কোম্পানি ৫০০—এমপিআর নামে বাংকার বিধ্বংসী বোমা তৈরি করেছে। যা ৪ মিটার পর্যন্ত পুরো কংক্রিট ভেদ করতে সক্ষম। এফ-১৫ আই যুদ্ধবিমান এই বোমাগুলো করতে পারে। কিন্তু ভারী হওয়ার কারণে, যুদ্ধবিমানগুলোর পাল্লা সংকুচিত হয়ে আসে এসব বোমা থাকলে।
পপআই টার্বো ক্ষেপণাস্ত্র
এই ক্ষেপণাস্ত্রটিও ফ্রান্সের রাফালে কোম্পানির তৈরি। এগুলোর পাল্লা প্রায় ১৫০০ কিলোমিটার। এগুলো পারমাণবিক ওয়ারহেডের পাশাপাশি প্রচলিত ওয়ারহেড বহনে সক্ষম। মূলত, ইসরায়েলি নৌবাহিনীর সাবমেরিন থেকে এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো নিক্ষেপ করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। দূর পাল্লার হওয়ার কারণে, লোহিত সাগর বা আরব সাগরে থেকেই—যা ইরান থেকে বেশ দূরে—ইসরায়েলি নৌবাহিনী এই ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইরানে হামলা চালাতে পারবে।