চাঁদাবাজি ও নারী কেলেঙ্কারি ভাইরালের ঘটনায় চৌগাছার ওসি পায়েল ক্লোজড

যশোর প্রতিনিধি : যশোরের চৌগাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পায়েল
হোসেনকে নারী কেলেঙ্কারি ভাইরালের ঘটনায় পুলিশ লাইনসে ক্লোজড করা হয়েছে।
দেড় মাস আগে চৌগাছা থানায় যোগদান করা এ ওসির বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারি
ছাড়াও টর্চার সেল পরিচালনা, ঘুষ ও রিমান্ড বাণিজ্য, চাঁদাবাজি,
ভয়ভীতিপ্রদর্শন, নিরীহ মানুষকে হয়রানি এবং নারী কেলেঙ্কারির মতো নানা
অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগ পুলিশের ভাবমূর্তিকে ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন করেছে
বলে জানা গেছে।

হোসেনকে এক নারীর সঙ্গে অশালীন আচরণ করতে দেখা যায়। ভিডিওতে তিনি হাসতে
হাসতে মোবাইলে কথা বলছেন এবং কখনো অশালীন ইঙ্গিত দিচ্ছেন। এমনকি,
একপর্যায়ে নিজের শরীরও প্রদর্শন করেন। ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার পরই বিষয়টি
নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা শুরু হয়।

এর আগে, “চাঁদাবাজিতে মেতেছেন চৌগাছা থানার ওসি” শিরোনামে রাতদিন নিউজে
২৩ ডিসেম্বর একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। ওই প্রতিবেদনে তার ঘুষ ও
চাঁদাবাজির নানা কার্যকলাপের বর্ণনা দেওয়া হয়েছিল। নিরীহ মানুষকে ভয়ভীতি
প্রদর্শন এবং রিমান্ডে নিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগও উঠে আসে।

রবিবার (২৯ ডিসেম্বর) ওসি পায়েল হোসেনকে যশোর পুলিশ লাইনসে ক্লোজড করার
সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যশোরের পুলিশ সুপার জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ বিষয়টি
নিশ্চিত করে বলেন, “ওসি পায়েলের কর্মকাণ্ডে পুলিশের ভাবমূর্তি
মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিষয়টি তদন্তের জন্য অতিরিক্ত পুলিশ
সুপার (অপরাধ) রুহুল আমিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন
করা হয়েছে। আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার
নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা
নেওয়া হবে।”

তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রুহুল আমিন
বলেছেন, “অভিযোগের যথাযথ তদন্ত করা হবে। সব পক্ষের বক্তব্য শোনা হবে এবং
সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হবে।”

পুলিশ প্রশাসন জানিয়েছে, তদন্ত কমিটি আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত
শেষ করে প্রতিবেদন জমা দেবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ওসি পায়েল হোসেনের
বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ওসি পায়েলের বিরুদ্ধে উঠা এমন গুরুতর অভিযোগ এবং ভিডিও প্রকাশের ঘটনায়
সাধারণ মানুষের মধ্যে পুলিশ প্রশাসনের প্রতি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে।
বিষয়টি দ্রুত সমাধান এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি
নিশ্চিত করা প্রশাসনের জন্য জরুরি।

অভিযোগ ও স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাকে ৪০
লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে তিনি সীমান্তবর্তী উপজেলা যশোরের চৌগাছা থানার ওসির
পদে আসীন হন। এ টাকা তুলতে তিনি জড়িয়ে পড়েন নানা অপকর্মে। প্রথম অভিযানে
চৌগাছা বাস মালিক সমিতির সভাপতি জসিম উদ্দিনের বাড়ি সারা রাত অবরুদ্ধ করে
রাখেন এবং এক কোটি টাকা দাবি করেন। চাঁদা না দেওয়ায় জসিম উদ্দিনকে একাধিক
মামলায় আসামি করেন।

উপজেলার ভাদড়া গ্রামের ব্যবসায়ী মানিক হোসেনকে আটক করে থানায় আনার পর
হাজতে না রেখে নিজের বাংলোতে আটকে শারীরিক নির্যাতন চালান। এ সময় মানিকের
স্ত্রীর কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে তা আদায় করেন। পরে অস্ত্রমামলায়
তাকে রিমান্ড আবেদনসহ আদালতে সোপর্দ করেন।

মাসিলা গ্রামের পারভেজ আহমেদ সোহাগ নামের এক যুবককে তুলে এনে ৩২ ঘণ্টা
আটকে রেখে ইলেকট্রিক শক ও নির্যাতনের মাধ্যমে তার পরিবারের কাছ থেকে দেড়
লাখ টাকা আদায় করেন। এরপরও তাকে ডাকাতি ও মাদক মামলায় আসামি দেখিয়ে
আদালতে সোপর্দ করেন। ২৩ নভেম্বর উপজেলার সিংহঝুলি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান
হামিদ মল্লিককে গ্রেপ্তার করে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন ওসি পায়েল। টাকা
দিতে অস্বীকার করায় তাকে চাঁদাবাজির মামলায় আদালতে পাঠানো হয়।

৭ ডিসেম্বর চৌগাছা বাজারের ব্যবসায়ী জীবন হোসেন লিপু এবং তার বন্ধু
বাবুলের ছোট ভাই হারিয়ে গেলে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
দুইদিন পর ওসি বাবুলকে ডেকে নিয়ে জানান, হারানো ব্যক্তিকে উদ্ধারে
অতিরিক্ত এসপির জন্য দুই লাখ টাকা লাগবে। নিরুপায় হয়ে বাবুল ৫০ হাজার
টাকা সংগ্রহ করে দেন। পরে ওই হারানো ব্যক্তিকে পরিবারের সদস্যরাই উদ্ধার
করলেও ওসি টাকা ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানান। এমনকি টাকা ফেরত চাওয়ায় ওসি
বাবুল ও জীবনের ছবি ও ফোন নম্বরসহ ‘দালাল হইতে সাবধান’ লেখা পোস্টার
থানার দেয়ালে সেঁটে দেন। মোবাইল ফোনে গুলি করার হুমকি দিয়ে তাদের চৌগাছা
ছাড়তে বাধ্য করেন।

সবশেষ শনিবার রাতে ৫ মিনিট ১৩ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সামাজিক
যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওটিতে দেখা যায়, ওসি পায়েল একটি মোবাইলে
কথা বলছেন আবার কখনো হাসতে হাসতে ওই নারীকে বিভিন্নভাবে অশালীন ইঙ্গিত
দিচ্ছেন। একপর্যায়ে নিজের শরীর প্রদর্শন করেন। এছাড়াও ওসি পায়েল এবং ওই
নারীর আরও তিনটি অডিও ক্লিপ গণমাধ্যমকর্মীদের হাতে এসেছে। যেখানে ওই
নারীকে রাতে তার সঙ্গে থাকতে ৫ হাজার টাকার প্রলোভন দেওয়া হয়। আরেকটি
অডিওতে ওই নারীকে চুম্বন করতে শোনা যায় ওসি পায়েলকে।

জানা গেছে, কিছুদিন আগে পারিবারিক বিরোধের জেরে ওই নারীর সঙ্গে তার
স্বামীর বিচ্ছেদ হয়। সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ওই নারীর সঙ্গে রাতে
থাকাসহ বিভিন্ন কুপ্রস্তাব দেন ওসি। কিন্তু ওই নারী রাজি না হওয়ায় তাকে
মামলা দিয়ে জেলে নেওয়ার হুমকি দেন।

ভুক্তভোগী ওই নারী সাংবাদিকদের জানান, তিনি তালাকপ্রাপ্ত, এই সুযোগে ওসি
পায়েল আমাকে বিভিন্ন সময়ে ফোন কল করে থানায় ডাকতো। বিভিন্নভাবে জোর
জবরদস্তি করতো। একদিন ওসি তার অফিস রুমের বাথরুমে নিয়ে জোর করে ‘চুম্বন’
করেন। তবে অপর একটি অডিওতে ওসির সঙ্গে তাকে রোমান্টিকভাবে কথা বলতে শোনা
যায়। সেখানে ওই নারী ওসিকে ‘তুমি’ বলেও সম্বোধন করেন। সেখানে ওসি তাকে
আসতে বললে তিনি খালার বাড়ি আছেন বলে জানান।

যদিও ভাইরাল হওয়া অডিও-ভিডিও প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ওসি পায়েল হোসেন
জানিয়েছিলেন, তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ওসি পায়েল হোসেন। তিনি
সাংবাদিকদের জানান, “আমি ষড়যন্ত্রের শিকার। আমাকে ট্র্যাপে ফেলা হয়েছে।”
যদিও এ বক্তব্যে তার বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা
পাওয়া যায়নি।

এদিকে, স্থানীয়দের মধ্যে একাংশ অভিযোগ করেছেন যে, এরকম ঘটনা নতুন নয়।
পুলিশের বিরুদ্ধে ঘুষ ও চাঁদাবাজির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ওসি পায়েলের ঘটনা
সেই ধারারই একটি অংশ বলে মনে করছেন অনেকে। ওসি পায়েল হোসেনের বিরুদ্ধে
উঠা অভিযোগগুলো শুধু তার ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা পুরো
পুলিশ প্রশাসনের ভাবমূর্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।