একাত্তরের উত্তাল মার্চে মালিগাছার যুদ্ধ

এবাদত আলী
১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে মহান মুক্তিযুদ্ধের সুচনালগ্নে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিনা উসকানিতে পাবনা পুলিশ লাইন আক্রমণ করে বসে। এসময় পাবনার অকুতভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতেৃত্ব পাবনার ছাত্র-জনতা তাদের সঙ্গে প্রতিরোধ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। উভয়পক্ষে তুমুল যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরাজয় বরণ করে।
পাবনা শহরের যুদ্ধে পরাজিত এক দল পাকিস্তানি সৈন্য কাশিপুর শিল্প নগরি হতে পায়ে হেঁটে রাজশাহীর দিকে পালিয়ে যাবার পথে রাতের বেলা পথ হারিয়ে শহরের অদূরে বালিয়াহালট গোরস্থানে লুকিয়ে থাকে। পরদিন সকাল বেলা স্থানীয় লোক জন তাদের দেখে ফেলে এবং জনতা এক জোট হয়ে তাদেরকে ঘিরে ফেলে। তারা সারেন্ডার করার জন্য বার বার আকুতি জানায়। কিন্তু হানাদার বাহিনীর আকুতি গ্রাহ্য হয়না। তাদের দু জনকেই হত্যা করা হয়। অপর সৈন্যরা রাতের বেলা পাকা সড়ক ধরে না গিয়ে কাঁচা রাস্তা দিয়ে পালাবার সময় পথ ভুল করে পাবনা শহর থেকে ৪ মাইল পশ্চিমে মালিগাছা ইউনিয়নের টেবুনিয়া বাজারের অদুরে মজিদপুর জিয়ালগাড়া বিল নামক স্থানে একটি গমের ক্ষেতে আশ্রয় নেয়। পর দিন ২৯ মার্চ -১৯৭১, ভোর বেলা তাদের এ হেন অবস্থান জানতে পেরে চারদিক থেকে অগনিত মানুষ তাদেরকে ঘিরে ফেলে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের হাতের অস্ত্র তাক করে জনতাকে ইশারায় সরে যেতে বলে। এতে লোকজনের ধারণা জন্মে যে, পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলি ফুরিয়ে গেছে তাই তারা লোক জনকে সরে যেতে ইশারা করছে।
এই কথা ভেবে জোতকলসা গ্রামের গহের আলী অতি সাহসের সাথে পাকিস্তানি সেনাদের দিকে ঢিল ছুড়তে থাকে। তখন পাকিস্তানি সেনারা গহেরকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লে ঘটনাস্থলেই তিনি লুটিয়ে পড়েন। তারা পুনরায় পাবনা শহরের দিকে রওনা হয়। ততক্ষনে খবর পেয়ে পাবনা শহর থেকে জিপে করে ই পি আর, পুলিশ ও মুক্তিকামি সেচ্ছাসেবক দল মনোহরপুর বড় শাকোর কাছে এসে অবস্থান নেয়। উক্ত দলের সদস্যরা কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে মনোহরপুর উত্তর পাড়া আব্বাস ফারাজির আম বাগান এবং মালিগাছা গ্রামের মোল্লাপাড়াসহ অন্যান্য বাড়িতে অবস্থান নেয়। তারা গুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মালিগাছা পাকা সড়কের উত্তরে কেফাত মোল্লার বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে বাংকার খনন করে গুলি ছুঁড়তে থাকে। অপর দিকে জেলার আটঘরিয়া থানার এ এস আই (বাড়ি যশোর পরে ফরিদ পুর জেলার আলফাডাঙ্গা থানার বড়ভাগ গ্রামে।) থানা থেকে কয়েকজন পুলিশ ও অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে পাকা রাস্তার দক্ষিন পার্শ্বে অবস্থান নেন। এ সময় আটঘরিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা আজিজুর রহমান ফনি মিয়া ও মালিগাছা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ইদ্রিস আলী খান তাঁদের লাইসেন্স কৃত বন্দুক দিয়ে এক সঙ্গে গুলি ছুঁড়তে থাকেন। ই পি আর পুলিশ ও সেচ্ছাসেবি মুক্তিকামিরা তিন দিক থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে ঘিরে ফেলে। মালিগাছা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা ম জয়নুল আবেদীন, এডওয়ার্ড কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ( বর্তমানে সাংবাদিক ও কলামিস্ট) বাদলপাড়া গ্রামের এবাদত আলী, একই গ্রামের আফ্ফান আলী, হিমায়েত পুর ইউনিয়নের চকচিরোট গ্রামের মোঃ হারেজ আলী, সামসুল আলম গান্ধী, বারইপাড়া গ্রামের আবেদ আলী প্রামাণিক ওরফে বেগে, রাণী গ্রামের করিম ড্রাইভার, আবু সাঈদ, মনিদহ গ্রামের জালাল বিশ্বাস, রিয়াজ উদ্দিন, রামচন্দ্রপুর গ্রামের মতিয়ার রহমান, আটঘরিয়ার দেবোত্তর গ্রামের ডাঃ মিজানুর রহমান ওরফে প্রদীপ ডাক্তার, মালিগাছা গ্রামের আব্দুলজব্বার ও মনোহরপুর গ্রামের আবু বকর সিদ্দিকসহ অগণিত মুক্তি কামি যোদ্ধা সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন।
মালিগাছার সম্মুখ যুদ্ধে অতি সাহসি ভুমিকা নিয়ে এ এস আই আব্দুল জলিল এক সময় ২ জন পাকিস্তানি হানাদার বহিনীর সদস্যকে গুলি করে হত্যা করেন। তিনি সহযোদ্ধাদের নিষেধ উপেক্ষা করে দুর্বার সাহস নিয়ে শত্রু হননের জন্য মেতে উঠলেন। তিনি পাকা সড়কের পাশে মাথা উঁচু করে কেফাত মোল্লার বাড়ির দিকে পাকিস্তানি সৈন্যদের অবস্থান লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে লাগলেন। মুক্তিকামি সহযোদ্ধাগণ চিৎকার করে তাঁকে নিচে নেমে আসার অনুরোধ জানাতে থাকেন। কিন্তু তিনি কারো কথা কর্নপাত না করে পাকিস্তানি হানাদারদের লক্ষ্য করে অবিরাম গুলি ছুঁড়তে লাগলেন। হঠাৎ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের কয়েকটি বুলেট তাঁর মুখ, বুক ও মস্তক ঝাঁজরা করে দেয়। তিনি সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
আব্দুল জলিল শহীদ হবার পর মুক্তিকামি যোদ্ধাদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে। অপর দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একাধিক সৈন্য নিহত হওয়ায় বাকি সৈন্যরাও আপাতত গোলাগুলি বন্ধ রাখে। এই যুদ্ধে নিহত পাকিস্তানি আর্মিদের নিকট থেকে অস্ত্র আনতে গিয়ে পাবনা শহরতলির মক্তপাড়ার শেখ লুৎফর রহমানের পুত্র আহসান শেখসহ অপর দুজন নিহত হন। মালিগাছা রণাঙ্গনে পার্শ্ববর্তী ঘরনাগড়া গ্রামের আকমল হোসেন ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে আহত হন।
পরে আব্দুল জলিলের লাশ আটঘরিয়া থানায় নিয়ে যাবার পথে দেবোত্তর বাজারের পাশে জামে মসজিদ সংলগ্ন স্থানে কবর দেওয়া হয়। উক্ত স্থানে শহীদ আব্দুল জলিলের বাঁধানো কবর রয়েছে। জিয়ালগাড়া বিলে নিহত গহের আলীকে সন্ধ্যার দিকে টেবুনিয়া গোরস্থানে দাফন করা হয়। অপর যুবকদের লাশ তাদের আত্মীয় স্বজনেরা নিয়ে যায়। মালিগাছার এই যুদ্ধে নিহত পাকিস্তানি সেনাদের মরদেহ এলাকার লোকজন পাশেই গর্ত খুঁড়ে মাটি চাপা দিয়ে রাখে। কেফাত মোল্লার বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে ক্ষুধা-তৃঞ্চায় কাতর বাদ বাকি সৈন্যরা সুযোগ বুঝে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যায়।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর মালিগাছার মুক্তিযুদ্ধের সেই স্থানটি চিহ্নিত করে সেখানে একটি যুদ্ধ স্মৃতি স্মম্ভ নির্মানের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় এবং প্রতি বছর ২৯শে মার্চ তারিখে মুক্তিযুদ্ধের এই দিনটিকে স্মরণ করার লক্ষ্যে সাংবাদিক ও কলমিস্ট এবাদত আলীকে সভাপতি ও সাংবাদিক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বারকে সাধারণ সম্পাদক করে “ মালিগাছা ইউনিয়ন মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটি” নামে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে প্রতি বছর মালিগাছা রণাঙ্গনে স্মরণ সভা, দোয়ার মাহফিলসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। (লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

প্রেরক ঃ এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব
তারিখ – ২৮/০৩/২০২৫

preload imagepreload image