তাড়াইলে কৃষকদের দেওয়া সরকারি প্রনোদনা কালোবাজারিতে বিক্রির অভিযোগ উপসহকারীর রিপনের বিরুদ্ধে

তাড়াইল (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধ:

কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার দামিহা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে কৃষক যেমন আশ্চর্য হয়েছেন, তেমনি অবাক হতে হয়েছে এই সংবাদকর্মীকেও। শতক শতক জমি চাষ করা কৃষকগণ তাদের এলাকায় দায়িত্বরত কৃষি উপসহকারী কর্মকর্তাকে ৫/৬ বছরে চোখেও দেখেননি। অনেকের মতে, কৃষি নিয়ে ভাবার জন্য ‘সরকারি লোক’ আছেন, এটি তাঁরা জানেনই না!

দামিহা ইউনিয়নের ১ নং, ৫ নং, ৬ নং ও ৪ নং ওয়ার্ডের কিছু অংশের দায়িত্বে আছেন কৃষি উপসহকারী কর্মকর্তা মুস্তাফিজুর রহমান রিপন। এই সমস্ত ওয়ার্ডের কৃষকগণ শতক শতক জমিতে ফসল উৎপাদন করে থাকে। কিন্তু তারা কৃষি উপসহকারীর দেখা পান না।

দামিহা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের হাছলা গ্রামের কৃষক আলাল উদ্দিন, আবদুল কাইয়ূম ও নুরুল হক মিয়া এ প্রতিবেদককে বলেন, কৃষি ও কৃষকদের খবর রাখতে সরকার লোক রাখছে, এটা এই প্রথম আপনার মুখে শুনছি। আমরা পুরাতন কৃষক। বাপ-দাদার আমল থেকেই ধান সহ সকল প্রকারের সবজি খেত আমরা করি। তারা বলেন, প্রতি বছরই প্রায় কয়েক শতক জমি বিভিন্ন ভাইরাস ও পোকা-মাকরের আক্রমনে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে আমাদের কয়েক লক্ষ টাকার ফসল ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয়। আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে টাকা দিয়ে লোক (কৃষি বিশেষজ্ঞ) এনে জমির গাছ দেখাই। বছরের পর বছর পার হয়ে যাচ্ছে সরকারি কোনো লোক আমাদের এই হাওরে আসে নাই। যদি জানতাম আমাদের কৃষি জমি দেখার জন্য সরকারি লোক আছে, তাহলে তো টাকা দিয়ে লোত আনতে হয় না।

দামিহা ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের নগরকুল গ্রামের কৃষক লিটন পাল ও উৎপল বিশ্বাসের অভিযোগ করে বলেন, আমাদের জন্য রিপন নামে একজন কৃষি উপসহকারী আছে সেটা জানি। কিন্তু ৪-৫ পাঁচ বছরেও সে আমাদের কৃষি ফসলের মাঠে আসেন না। উপজেলা কৃষি অফিসে গিয়েছিলাম কৃষি বিষয়ে পরামর্শের জন্য। তখন তাকে দেখতে পেয়ে তার কাছে বোরো খেতের ফলন বাড়ানোর বিষয়ে পরামর্শ চাইলে তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেন। তিনি আমাদের বলেন, আমি কি আপনাদের কামলা দিই। আপনারা বললেই মাঠে যেতে হবে, যা পারেন করেন গা। এই বলে আমাকে তাড়িয়ে দেয়।

দামিহা ১ নম্বর ওয়ার্ডের দামিহা নয়াপাড়া গ্রামের কৃষক বাদল মিয়ার সাথে কথা বলে আরও জানা যায়, সার, বীজ, জিনিসপত্র এগুলা তো মাঠের কৃষকেরে দেয় না, দেয় বাঁটের কৃষকেরে। কৃষক বাদল মিয়া ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন, মাঠের কৃষকের চেয়ে বাঁটের (বাঁটোয়ারার) কৃষকের জন্য টান (আগ্রহ) বেশি কৃষি উপসহকারী কর্মকর্তা মুস্তাফিজুর রহমান রিপনের।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারি প্রণোদনার সার, বীজ ও কৃষি উপকরণ বিতরণের তালিকায় অটোরিকশাচালক, মৎস্যজীবী, বেকার ও গৃহস্থরা স্থান পেলেও নজর দেওয়া হয়নি মাঠের কৃষকের দিকে। তালিকাভুক্ত অকৃষিজীবীরা প্রণোদনার সার, বীজ এনে বিক্রি করেছেন প্রকৃত কৃষকের কাছে। কারো কারো মতে উপসহকারী রিপন নিজেই দামিহা বাজার ও হাছলা মোড়ে বসে প্রভাবশালীদের সাথে মিলে কৃষি প্রনোদনার মালামাল কালোবাজারিতে বিক্রি করে দেন।

কৃষক বাঁচলে, দেশ বাঁচবে। তাই কৃষি ও কৃষকের সমস্যা দূর করতে কাজ করছে সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। কিন্তু কৃষিকে সম্প্রসারণের দায়িত্ব পাওয়া দপ্তরটির কর্মকর্তারাই ঠিক করতে পারেননি, ঠিক কী ধরনের উদ্যোগে তাড়াইল উপজেলার কৃষকদের একটি লাভজনক ও টেকসই কৃষিজীবিকার পথ দেখাতে পারে।

কৃষিজমিতে যে অল্পসংখ্যক কৃষক এখনো কৃষিতে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন, তাঁদের চাওয়া খুবই সুনির্দিষ্ট। খরা, রোগবালাই আর দুর্যোগের মুখে টিকে থাকার কৌশল জানতে চান তাঁরা। সেই সঙ্গে তাঁদের দাবি, কৃষকের ন্যায্য প্রাপ্য যেন কৃষকই পায়। কৃষিকাজ ছেড়ে দেওয়া মানুষেরা পরবর্তিতে কী কাজ করছেন? জানতে চাইলে কৃষকেরা বলেন, যাঁরা চাষ ছেড়ে দিয়েছেন বা বেকার, তাঁরা অটোরিকশা চালানো, মাটি পরিবহনের ট্রাকে শ্রম দেওয়া অথবা বদলা খাটার মতো কাজ করছেন।

দামিহা ইউনিয়নের ৪টি ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা কৃষি উপসহকারী কর্মকর্তা মুস্তাফিজুর রহমান রিপনের কাছে কৃষকদের করা অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিনামূল্যে সরকারের দেওয়া প্রণোদনা সকলকে দেওয়া সম্ভব না। সরকারি নিয়মের কথা জিজ্ঞাসা করিলে, এসব নিয়ম কাগজে কলমে আছে, নিয়মের বাহিরেও কিছু নিয়ম থাকে। আমার চাকুরী সুবিধার্থে কৃষক ছাড়াও বিভিন্ন মহলকে সরকারি প্রণোদনা দিতে হয়। কারণ অনেক সময় তারা আমাদের দেখ ভাল করে।

তাড়াইল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বিকাশ রায়ের কাছে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মুস্তাফিজুর রহমান রিপন সম্পর্কে কৃষকদের করা অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার বিষয়ে কৃষকদের করা অনেক অভিযোগ রয়েছে আমার কাছে। আমি অতিদ্রুত কৃষকদের করা অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখব। প্রকৃত কৃষকদের জন্য বিনামূল্যে সরকারের দেওয়া প্রণোদনার বিষয়ে তিনি বলেন, এলাকার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্যদের কাছ থেকেই কৃষকের তালিকা নেওয়া হয়। ‘তালিকা পেয়ে কৃষক শনাক্তের দায়িত্ব কার’ প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এতে আমাদের কিছু করার থাকে না। উপসহকারী মুস্তাফিজুর রহমান রিপন এখানকার স্থানীয়। এই সুবাধে এলাকার নেতৃবৃন্দের সাথে উঠাবসা আছে। তাই হয়তো কয়েকজন নেতার মন রক্ষার্থে তাদের নাম দিয়েছে। বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখব।

preload imagepreload image