এবাদত আলী
পবিত্র রমজান মাসের সবচেয়ে পুণ্যময় একটি রজনীর নাম হচ্ছে লাইলাতুল কদর যা ‘শ‘বে কদর’ নামে পরিচিত। এর অর্থ হলো অতিশয় সন্মানিত এবং মহিমান্বিত বা পবিত্র রজনী। আরবি ভাষায় ‘লাইলাতুল’ অর্থ হলো রাত্রি বা রজনী এবং কদর শব্দের অর্থ সন্মান, মর্যাদা, মহাসন্মান। এছাড়া এর অন্য অর্থ হচ্ছে ভাগ্য বা তাকদির নির্ধারণ করা। অপর দিকে শাব ফারসি শব্দ যার অর্থ রাত্রি বা রজনী তাই এই রাতকে শ‘বে কদরও বলা হয়ে থাকে।
ইসলাম ধর্ম অনুসারে, এ রাতে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর সন্মান বৃদ্ধি করা হয় এবং মানব জাতির ভাগ্য পুননির্ধারণ করা হয়। তাই প্রতিটি মুসলমানের কাছে এই রাত অত্যন্ত তাৎপর্যপুর্ণ ও মহাসন্মানিত হিসেবে পরিগণিত।
লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ রাতকে সকল রাতের শ্রেষ্টত্বের মর্যাদা দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে এ রাতকে প্রশংসার সাথে উল্লেখ করেছেন আল্লাহ নিজেই। তিনি তার কালাম সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইরশাদ করেন, নিশ্চই আমি এটি নাজিল করেছি বরকতময় রাতে; নিশ্চই আমি সতর্ককারী। সে রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপুর্ণ সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়, আমার নির্দেশে। নিশ্চই আমি রাসুল প্রেরণকারী। তোমার রবের কাছ থেকে রহমত হিসেবে; নিশ্চই তিনি সর্বশ্রোতা,সর্বজ্ঞ। যিনি আসমানসমুহ জমিন ও এ দুয়ের মধ্যবর্তী সব কিছুর রব’ যদি তোমরা দৃঢ় বিশ^াস পোষণকারী হও। তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনিই জীবন দান করেন এবং মৃত্যু দেন। তিনি তোমাদের রব এবং তোমাদের পিতৃ পুরুষদের রব। (সুরা দুখান ৩-৮)।
৬১০ সালে শবে কদরের রাতে মক্কার নূর পর্বতের হেরা গুহায় ধ্যানরত ইসলাম ধর্মের মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর নিকট সর্বপ্রথম পবিত্র কোরআন নাজিল হয়। সর্বপ্রথম তার নিকট প্রথম সুরা আলাকের পাঁচটি আয়াত নাজিল হয়। এ রাতে আল্লাহর ফেরেশেতা হজরত জীবরাইল (আ.) এর নিকট সম্পুর্ণ কোরআন অবতীর্ণ হয় যা পরবর্তিতে ২৩ বছর ধরে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর নিকট তাঁর বিভিন্ন প্রয়োজনীয়তা এবং ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট আয়াত আকারে নাজিল করা হয়।
মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় গ্রন্থ আল কোরআনে সুরায়ে ক্বদর নামে ্একটি পুর্ণ সুরা নাজিল হয়েছে। এই সুরায় শবে কদরের রাত্রিকে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এক হাজার মাসে তিরাশি বছর চার মাস হয়ে থাকে। ঐ ব্যক্তি ভাগ্যবান যে এই রাতটি ইবাদত বন্দেগীর মধ্যে কাটিয়ে দিতে পারে। কেননা, এর মাধ্যমে সে তিরাশি বছর চার মাসের চেয়েও বেশি সময় ইবাদতে লিপ্ত থাকার স্যেভাগ্য অর্জন করলো। পবিত্র কোরআন পাকে হাজার মাসের অধিক বলার কারণ হলো তখনকার আরবদের মধ্যে গণনার ক্ষেত্রে হাজারকেই সবচেয়ে বড় সংখ্যা গণ্য করা হতো। অতএব কোরআনের উদ্দেশ্য এখানে হাজার মাসে সীমাবদ্ধ করা নয়; বরং অধিক বুঝানোই উদ্দেশ্য। সুরা আল ক্বদরে মহান আাল্লাহ রাব্বুল আলামিন এরশাদ করেন, ‘‘ নিশ্চই আমি নাজিল করেছি এ ক্বুরআন মহামান্বিত রাত্রিতে। আর আপনি কি জানেন মহিমান্বিত রাত্রি কি? মহামান্বিত রাত্রি হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। সেই রাতে প্রত্যেক কাজের জন্য ফেরেশতাগণ এবং রূহ তাদের প্রতিপালকের আদেশক্রমে অবতীর্ণ হয়। সেই রাত্রি শান্তিই শান্তি ফজর হওয়া পর্যন্ত।’’ (আল ক্বদর ১-৫)
আবু হুরাইরাহ্ (রা.) হতে বর্ণিত যে, রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি রমজানে ঈমানের সাথে ও সওয়াব লাভের আশায় সওম পালন করে তার পুর্ববর্তী গুনাহ্সমূহ মাফ করে দেওয়া হয় এবং যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে, সওয়াব লাভের আশায় লাইলাতুল ক্বদরে রাত জেগে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করে, তার পুর্ববর্তী গুনাহ্সমূহ মাফ করে দেওয়া হয়।
সহীহ হাদীস থেকে জানা যায় যে, লাইলাতুল ক্বদর রমাজানের শেষ দশ দিনের যে কোন বিজোড় রাত্রিতে হয়ে থাকে। বিভিন্ন সহীহ হাদীসে ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখে রাইলাতুল ক্বদর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা উল্লেখ আছে। হাদীসে এ কথাও উল্লেখ আছে যে কোন একটি বিজোড় রাত্রিতেই তা হয়না। অর্থাৎ কোন রছর ২৫ তারিখে হলো, আবার কোন বছর ২১ তারিখে হলো এভাবে।
হজরত আয়িশাহ্ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ই’তিকাফ করতেন এবং বলতেন তোমরা রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করো। (২০১৭)। হজরত আবু সা‘ঈদ খুদরী (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) রমজান মাসের মাঝের দশকে ই‘তিকাফ করেন। বিশ তারিখ অতীত হওয়ার সন্ধ্যায় এবং একুশ তারিখের শুরুতে তিনি এবং তাঁর সঙ্গে যাঁরা ই‘তিকাফ করেছিলেন সকলেই নিজ নিজ বাড়িতে প্রস্থান করেন এবং তিনি যে মাসে ই‘তিকাফ করেন ঐ মাসের যে রাতে ফিরে যান সে রাতে লোকদের সামনে ভাষণ দেন। আর তাতে মাশাআল্লাহ, তাদেরকে বহু নির্দেশ দান করেন, অতঃপর বলেন যে আমি ্এই দশকে ই‘তিকাফ করেছিলাম। এরপর আমি সিদ্ধান্ত করেছি যে, শেষ দশকে ই‘তিকাফ করবো। যে আমার সঙ্গে ই‘তিকাফ করেছিলো সে যেন তার ই‘তিকাফস্থলে থেকে যায়। আমাকে সে রাত দেখানো হয়েছিলো পরে তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, শেষ দশকে ঐ রাতের তালাশ করো এবং প্রত্যেক বিজোড় রাতে তা তালাশ করো। আমি সপ্নে দেখেছি যে, ঐ রাতে আমি কাদা-পানিতে সিজদা করছি। ঐ রাতে আকাশে প্রচুর মেঘের সঞ্চার হয় এবং বৃষ্টি হয়। মসজিদে আল্লাহর রাসুল (সা.) এর সালাতের স্থানেও বৃষ্টির পানি পড়তে থাকে। এটা ছিলো একুশ তারিখের রাত। যখন তিনি ফজরের সালাত শেষে ফিরে বসেন তখন আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই যে, তাঁর মুখমন্ডল কাদা পানি মাখা।(৬৬৯, মুসলিম ১৩/৪০, হাঃ ১১৬৭) (আধুনিক প্রকততাশনীঃ ১৮৭৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৮৮৮)
আমাদের দেশে সরকারি আর বেসরকারিভাবে জাঁকজমকের সঙ্গে রমজান মাসের ২৭ তারিখের রাত্রিকে লাইতুল কদরের রাত হিসেবে পালন করা হয়। এই ভাবে মাত্র একটি রাত্রিকে লাইতুল কদর সাব্যস্ত করার কোন হাদীস নেই। লাইলাতুল ক্বদরের সওয়াব পেতে চাইলে ৫টি বিজোড় রাত্রেই তালাশ করতে হবে। (লেখক; সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।
