সর্বজনশ্রদ্ধেয় মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী

আজ ১৭ নভেম্বর (শনিবার) সর্বজনশ্রদ্ধেয় জাতীয় নেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৬ সালের এইদিনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরে টাঙ্গাইলের সন্তোষে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।

রাজধানী ঢাকাসহ টাঙ্গাইলের সন্তোষে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হবে।

১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের ধানগড়া পল্লীতে জন্ম নেয়া ভাসানী ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে পীর সৈয়দ নাসীরুদ্দীনের সাথে আসামে যান। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের হাত ধরে তিনি ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগ দেন এবং অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়ে দশ মাস কারাভোগ করেন।

১৯২৩ সালে কংগ্রেসত্যাগী দেশবন্ধুর স্বরাজ পার্টি সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখেন। ১৯২৯-এ আসামের ভাসান চরে কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলেন। এরপর থেকে তার নামের শেষে ‘ভাসানী’ শব্দটি যুক্ত হয়।

১৯৪৫-৪৬ সালে আসামজুড়ে উগ্রপন্থিদের ‘বাঙাল খ্যাদাও’ কর্মসূচির ফলে দাঙ্গা দেখা দেয়। বাঙালিদের রক্ষার জন্য ভাসানী আসামের বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলন গড়ে তোলেন।

১৯৪৬-৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতে দাঙ্গার মুখে অস্তিত্বের ঝুঁকিতে পড়া সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্য মুসলিম লীগের নেতৃত্বে স্বাধীন পাকিস্তান সৃষ্টিতে তিনি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ নিয়ে ১৯৪৭ সালে আসামে গ্রেফতার হয়ে মুক্তি মেলে ১৯৪৮-এ। এরপর তিনি টাঙ্গাইলের সন্তোষে ফিরে আসেন।

পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ববঙ্গের প্রতি বৈষম্যের ব্যাপারে সরকারের তীব্র সমালোচনা শুরু করেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ববঙ্গের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগের আত্মপ্রকাশে ভূমিকা রাখেন।

১৯৪৯-এর ১৪ অক্টোবর ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ‘ভুখা মিছিলে’ নেতৃত্ব দেয়ার জন্য গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন।

১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৮-১০ ফেব্রুয়ারি কাগমারী সম্মেলনে তিনি পাকিস্তানের শাসকদের ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম’ বলে সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার ঐতিহাসিক ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন। একই সম্মেলনে ভাসানী পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি জানান।

প্রধানমন্ত্রী সোহ্‌রাওয়ার্দী সেই দাবি প্রত্যাখান করলে ১৮ মার্চ আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। একই বছর ২৫ জুলাই তার নেতৃত্বে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হয়।

ন্যাপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভাসানী প্রকাশ্যে বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। রাজনৈতিক জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তিনি মাওবাদী রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। মাও সেতুং তাকে ‘রেড মওলানা’ নামে ডাকতেন। তিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে ‘মজলুম জননেতা’ হিসেবে বেশি পরিচিত।

১৯৫৭-র ৭ অক্টোবর দেশে সামরিক শাসন জারি হলে আইয়ুব খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সকল রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১২ অক্টোবর মাওলানা ভাসানীকে কুমুদিনী হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকায় ৪ বছর ১০ মাস কারারুদ্ধ থাকেন।

১৯৬৭-তে রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচার বন্ধের প্রতিবাদ করেন। ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের মুক্তি দাবির মধ্য দিয়ে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানে রূপদানের মৌলিক ভূমিকা তিনিই পালন করেন।

১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে প্রলয়ঙ্কারী ঘুর্ণিঝড় হলে ন্যাপ বর্জন করে। ৪ ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় মওলানা ভাসানী ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ দাবি উত্থাপন করেন।

১৯৭১ এর মার্চ মাসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন প্রদান করেন এবং ১৮ জানুয়ারি ১৯৭১ পল্টন ময়দানে অণুষ্ঠিত জনসভায় স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের জন্য তার প্রতি আহ্বান জা্নান।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত চলে যান এবং মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হন।

মাওলানা ভাসানী ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীচুক্তির বিরোধিতা করলেও মুজিব সরকারের জাতীয়করণ নীতি এবং ১৯৭২-এর সংবিধানের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন।

১৯৭৩ সালে খাদ্যের দাবিতে ঢাকায় ১৫-২২ মে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। ১৯৭৬-এর ১৬ মে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ঐতিহাসিক লং মার্চে নেতৃত্ব দেন।